প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
কুমুকে কঠিনভাবে শাসন করবার শক্তি মধুসূদন দেখতে দেখতে হারিয়ে ফেলেছে, এখন তার নিজের তরফে যে-সব অপূর্ণতা তাই তাকে পীড়া দিতে আরম্ভ করেছে। তার বয়স বেশি এ কথা আজ সে ভুলতে পারছে না। এমন-কি, তার যে চুলে পাক ধরেছে সেটা সে কোনোমতে গোপন করতে পারলে বাঁচে। তার রঙটা কালো, বিধাতার সেই অবিচার এতকাল পরে তাকে তীব্র করে বাজছে। কুমুর মনটা কেবলই তার মুষ্টি থেকে ফসকে যাচ্ছে, তার কারণ মধুসূদনের রূপ ও যৌবনের অভাব, এতে তার সন্দেহ নেই। এইখানেই সে নিরস্ত্র সে দুর্বল। চাটুজ্যেদের ঘরের মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু সে যে এমন মেয়ে পাবে বিধাতা আগে থাকতেই যার কাছে তার হার মানিয়ে রেখে দিয়েছেন, এ সে মনেও করে নি। অথচ এ কথা বলবারও জোর মনে নেই যে তার ভাগ্যে একজন সাধারণ মেয়ে হলেই ভালো হত, যার উপরে তার শাসন খাটত।
মধুসূদন কেবল একটা বিষয়ে টেক্কা দিতে পারে! সে তার ধনে। তাই আজ সকালেই ঘরে জহরি এসেছিল। তার কাছ থেকে তিনটে আংটি নিয়ে রেখেছে, দেখতে চায় কোন্টাতে কুমুর পছন্দ। সেই আংটির কৌটা তিনটি পকেটে নিয়ে সে তার শোবার ঘরে গেল। একটা চুনি, একটা পান্না, একটা হীরের আংটি। মধুসূদন মনে মনে একটি দৃশ্য কল্পনাযোগে দেখতে পাচ্ছে। প্রথমে সে যেন চুনির আংটির কৌটা অতি ধীরে ধীরে খুললে, কুমুর লুব্ধ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার পরে বেরোল পান্না, তাতে চক্ষু আরো প্রসারিত। তার পর হীরে, তার বহুমূল্য উজ্জ্বলতায় রমণীর বিস্ময়ের সীমা নেই। মধুসূদন রাজকীয় গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললে, ‘তোমার যেটা ইচ্ছে পছন্দ করে নাও।’ হীরেটাই কুমু যখন পছন্দ করলে তখন তার লুব্ধতার ক্ষীণ সাহস দেখে ঈষৎ হাস্য করে মধুসূদন তিনটে আংটিই কুমুর তিন আঙুলে পরিয়ে দিলে। তার পরেই রাত্রে শয়নমঞ্চের যবনিকা উঠল।
মধুসূদনের অভিপ্রায় ছিল এই ব্যাপারটা আজ রাত্রের আহারের পর হবে। কিন্তু দুপুরবেলাকার দুর্যোগের পর মধুসূদন আর সবুর করতে পারলে না। রাত্রের ভূমিকাটা আজ অপরাহ্নে সেরে নেবার জন্যে অন্তঃপুরে গেল।
গিয়ে দেখে কুমু একটা টিনের তোরঙ্গ খুলে শোবার ঘরের মেজেতে বসে গোছাচ্ছে। পাশে জিনিসপত্র কাপড়চোপড় ছড়ানো।
“এ কী কাণ্ড! কোথাও যাচ্ছ নাকি?”
“হাঁ।”
“কোথায়?”
“রজবপুরে।”
“তার মানে কী হল?”
“তোমার দেরাজ খোলা নিয়ে ঠাকুরপোদের শাস্তি দিয়েছ। সে শাস্তি আমারই পাওনা।”
‘যেয়ো না’ বলে অনুরোধ করতে বসা একেবারেই মধুসূদনের স্বভাববিরুদ্ধ। তার মনটা প্রথমেই বলে উঠল— যাক-না দেখি কতদিন থাকতে পারে। এক মুহূর্ত দেরি না করে হন্ হন্ করে ফিরে চলে গেল।