প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
“তাই দেখেছি বটে, ঝুড়ি করে রাবিশ বয়ে আনছিলি।”
“বউদিদি, তুমি আমার চিরকালের মনিব। তোমারই চোখের সামনে আমার মাথা হেঁট করে দিলে। দেশের লোকের কাছে আমার জাত যাবে। আমি কি কুলিমজুর।”
“আচ্ছা, এখন যা। তোদের দিদিমণি যখন তোকে ইঁটসুকরি বইতে বলবে আমার নাম করে বলিস আমি বারণ করেছি। দাঁড়িয়ে রইলি যে?”
“দেশ থেকে চিঠি এসেছে বড়ো হালের গোরুটা মারা গেছে।” ব’লে মাথা চুলকোতে লাগল।
নীরজা বললে, “না, মারা যায় নি, দিব্যি বেঁচে আছে। নে দুটো টাকা, আর বেশি বকিস নে।” এই বলে টিপাইয়ের উপরকার পিতলের বাক্স থেকে টাকা বের করে দিলে।
“আবার কী।”
“বউয়ের জন্যে একখানা পুরোনো কাপড়। জয়জয়কার হবে তোমার।” এই বলে পানের ছোপে কালো-বর্ণ মুখ প্রসারিত করে হাসলে।
নীরজা বললে, “রোশনি, দে তো ওকে আলনার ঐ কাপড়খানা।”
রোশনি সবলে মাথা নেড়ে বললে, “সে কি কথা, ও যে তোমার ঢাকাই শাড়ি!”
“হোক-না ঢাকাই শাড়ি। আমার কাছে আজ সব শাড়িই সমান। কবেই বা আর পরব।”
রোশনি দৃঢ়মুখ করে বললে, “না, সে হবে না। ওকে তোমার সেই লালপেড়ে কলের কাপড়টা দেব। দেখ্ হলা, খোঁখীকে যদি এমনি জ্বালাতন করিস বাবুকে বলে তোকে দূর করে তাড়িয়ে দেব।”
হলা নীরজার পা ধরে কান্নার সুরে বললে, “আমার কপাল ভেঙেছে বউদিদি।”
“কেন রে, কী হয়েছে তোর।”
“আয়াজিকে মাসি বলি আমি। আমার মা নেই, এতদিন জানতেম হতভাগা হলাকে আয়াজি ভালোবাসেন। আজ বউদিদি, তোমার যদি দয়া হল উনি কেন দেন বাগড়া। কারও দোষ নয় আমারই কপালের দোষ। নইলে তোমার হলাকে পরের হাতে দিয়ে তুমি আজ বিছানায় প’ড়ে!”
“ভয় নেই রে, তোর মাসি তোকে ভালোই বাসে। তুই আসবার আগেই তোর গুণগান করছিল। রোশনি, দে ওকে ঐ কাপড়টা, নইলে ও ধন্না দিয়ে পড়ে থাকবে।”
অত্যন্ত বিরস মুখে আয়া কাপড়টা এনে ফেলে দিলে ওর সামনে। হলা সেটা তুলে নিয়ে গড় হয়ে প্রণাম করলে। তার পরে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “এই গামছাটা দিয়ে মুড়ে নিই বউদিদি। আমার ময়লা হাত, দাগ লাগবে।” সম্মতির অপেক্ষা না রেখেই আলনা থেকে তোয়ালেটা নিয়েই কাপড় মুড়ে দ্রুতপদে হলা প্রস্থান করলে।
নীরজা আয়াকে জিজ্ঞাসা করলে, “আচ্ছা আয়া, তুই ঠিক জানিস বাবু বেরিয়ে গেছেন?”
“নিজের চক্ষে দেখলুম। কী তাড়া। টুপিটা নিতে ভুলে গেলেন।”
“আজ এই প্রথম হল। আমার সকালবেলাকার পাওনা ফুলে ফাঁকি পড়ল। দিনে দিনে এই ফাঁকি বাড়তে থাকবে। শেষকালে আমি গিয়ে পড়ব আমার সংসারের আঁস্তাকুড়ে, যেখানে নিবে-যাওয়া পোড়া কয়লার জায়গা।”
সরলাকে আসতে দেখে আয়া মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল।
সরলা ঢুকল ঘরে। তার হাতে একটি অর্কিড। ফুলটি শুভ্র, পাপড়ির আগায় বেগনির রেখা। যেন ডানা-মেলা মস্ত প্রজাপতি।