যোগাযোগ

এমন সময়ে ওদের মধ্যে একটি মোটাসোটা কালোকোলো মেয়ে, মস্ত ডাগর চোখ, স্নেহরসে ভরা মুখের ভাব, কুমুর সমবয়সী হবে, ওর কাছে এসে বসল। চুপি চুপি বললে, “মন কেমন করছে ভাই? এদের কথায় কান দিয়ো না, দুদিন এইরকম টেপাটেপি বলাবলি করবে, তার পরে কণ্ঠ থেকে বিষ নেমে গেলেই থেমে যাবে।” এই মেয়েটি কুমুর মেজো জা, নবীনের স্ত্রী। ওর নাম নিস্তারিণী, ওকে সবাই মোতির মা বলে ডাকে।

মোতির মা কথা তুললে, “যেদিন নুরনগরে এলুম, ইস্টিশনে তোমার দাদাকে দেখলুম যে।”

কুমু চমকে উঠল। ওর দাদা যে স্টেশনে অভ্যর্থনা করতে গিয়েছিল সে খবর এই প্রথম শুনলে।

“আহা, কী সুপুরুষ! এমন কখনো চক্ষে দেখি নি। ঐ-যে গান শুনেছিলেম কীর্তনে—

                            গোরার রূপে লাগল রসের বান—
                            ভাসিয়ে নিয়ে যায় নদীয়ার পুরনারীর প্রাণ
আমার তাই মনে পড়ল।”

মুহূর্তে কুমুর মন গলে গেল। মুখ আড় করে জানলার দিকে রইল চেয়ে— বাইরের মাঠ বন আকাশ অশ্রুবাষ্পে ঝাপসা হয়ে গেল।

মোতির মা’র বুঝতে বাকি ছিল না কোন্‌ জায়গায় কুমুর দরদ, তাই নানারকম করে ওর দাদার কথাই আলোচনা করলে। জিজ্ঞাসা করলে বিয়ে হয়েছে কি না।

কুমু বললে, “না।”

মোতির মা বলে উঠল, “মরে যাই! অমন দেবতার মতো রূপ, এখনো ঘর খালি! কোন্‌ ভাগ্যবতীর কপালে আছে ঐ বর!”

কুমু তখন ভাবছে— দাদা গিয়েছিলেন সমস্ত অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে, কেবল আমারই জন্যে! তার পরে এঁরা একবার দেখতেও এলেন না! কেবল্‌মাত্র টাকার জোরে এমন মানুষকেও অবজ্ঞা করতে সাহস করলেন! তাঁর শরীর এইজন্যেই বুঝি-বা ভেঙে পড়ল।

বৃথা আক্ষেপের সঙ্গে বার বার মনে মনে বলতে লাগল— দাদা কেন গেল ইস্টেশনে? কেন নিজেকে খাটো করলে? আমার জন্যে? আমার মরণ হল না কেন?

যে কাজটা হয়ে গেছে, আর ফেরানো যাবে না, তারই উপর ওর মনটা মাথা ঠুকতে লাগল। কেবলই মনে পড়তে লাগল, সেই রোগে-ক্লান্ত শান্ত মুখ, সেই আশীর্বাদে-ভরা স্নিগ্ধগম্ভীর দুটি চোখ।


২০

রেলগাড়ি হাওড়ায় পৌঁছল, বেলা তখন চারটে হবে। ওড়নায়-চাদরে গ্রন্থিবদ্ধ হয়ে বরকনে গিয়ে বসল ব্রুহাম গাড়িতে। কলকাতার দিবালোকের অসংখ্য চক্ষু, তার সামনে কুমুর দেহমন সংকুচিত হয়ে রইল। যে-একটি অতিশয় শুচিতাবোধ এই উনিশ বছরের কুমারীজীবনে ওর অঙ্গে অঙ্গে গভীর করে ব্যাপ্ত, সেটা যে কর্ণের সহজ কবচের মতো, কেমন করে ও হঠাৎ ছিন্ন করে ফেলবে? এমন মন্ত্র আছে যে মন্ত্রে এই কবচ এক নিমেষে আপনি খসে যায়। কিন্তু সে মন্ত্র হৃদয়ের মধ্যে এখানো বেজে ওঠে নি। পাশে যে মানুষটি বসে আছে, মনের ভিতরে সে তো আজও বাইরের লোক। আপন লোক হবার পক্ষে তার দিক থেকে কেবল তো বাধাই এসেছে। তার ভাবে ব্যবহারে যে একটা রূঢ়তা সে যে কুমুকে এখনো পর্যন্ত কেবলই ঠেলে ঠেলে দূরে ঠেকিয়ে রাখল।