যোগাযোগ
না। সবাই বললে, এ কাজটা কলকাতায় সেরে নিলে তো কারো কিছু বলবার কথা থাকত না। বাপের বাড়ির অপমানে কুমু একান্তই সংকুচিত হয়ে গেল— মনে হতে লাগল সে-ই যেন অপরাধিনী তার সমস্ত পূর্বপুরুষদের কাছে। মনে মনে তার ঠাকুরের প্রতি অভিমান করে বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগল, ‘আমি তোমার কাছে কী দোষ করেছি যেজন্যে আমার এত শাস্তি! আমি তো তোমাকেই বিশ্বাস করে সমস্ত স্বীকার করে নিয়েছি।’

বরকনে গাড়িতে উঠল। কলকাতা থেকে মধুসূদন যে ব্যান্ড এনেছিল তাই উচ্চৈঃস্বরে নাচের সুর লাগিয়ে দিলে। মস্ত একটা শামিয়ানার নীচে হোমের আয়োজন। ইংরেজ মেয়েপুরুষ অভ্যাগত কেউ-বা গদিওয়ালা চৌকিতে বসে, কেউ-বা কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগল। এরই মধ্যে তাদের জন্যে চা-বিস্কুটও এল। একটা টিপায়ের উপর মস্তবড়ো একটা ওয়েডিং কেকও সাজানো আছে। অনুষ্ঠান সারা হয়ে গেলে এরা এসে যখন কন্‌গ্র্যাচুলেট করতে লাগল, কুমু মুখ লাল করে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল। একজন মোটাগোছের প্রৌঢ়া ইংরেজ মেয়ে ওর বেনারসি শাড়ির আঁচল তুলে ধরে পর্যবেক্ষণ করে দেখলে; ওর হাতে খুব মোটা সোনার বাজুবন্ধ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতেও তার বিশেষ কৌতূহল বোধ হল। ইংরেজি ভাষায় প্রশংসাও করলে, অনুষ্ঠান সম্বন্ধে মধুসূদনকে একদল বললে, “how interesting”; আর একদল বললে, “isn’t it?”

এই মধুসূদনকে কুমু তার দাদা আর অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে ব্যবহার করতে দেখেছে— আজ তাকেই দেখলে ইংরেজ বন্ধুমহলে। ভদ্রতায় অতি গদ্‌গদভাবে অবনম্র, আর হাসির আপ্যায়নে মুখ নিয়তই বিকশিত। চাঁদের যেমন এক পিঠে আলো আর-এক পিঠে চির-অন্ধকার, মধুসূদনের চরিত্রেও তাই। ইংরেজের অভিমুখে তার মাধুর্য পূর্ণচাঁদের আলোর মতোই যেমন উজ্জ্বল তেমনি স্নিগ্ধ। অন্য দিকটা দুর্গম, দুর্দৃশ্য এবং জমাট বরফের নিশ্চলতায় দুর্ভেদ্য।

সেলুন-গাড়িতে ইংরেজ বন্ধুদের নিয়ে মধুসূদন; অন্য রিজার্ভ-করা গাড়িতে মেয়েদের দলে কুমু। তারা কেউ-বা ওর হাত তুলে টিপে দেখে, কেউ-বা চিবুক তুলে মুখশ্রী বিশ্লেষণ করে, কেউ-বা বলে ঢ্যাঙা, কেউ-বা বলে রোগা। কেউ-বা অতি ভালোমানুষের মতো জিজ্ঞাসা করে, “হাঁ গা, গায়ে কী রঙ মাখ, বিলেত থেকে তোমার ভাই বুঝি কিছু পাঠিয়েছে?” সকলেই মীমাংসা করলে, চোখ বড়ো নয়, পায়ের মাপটা মেয়েমানুষের পক্ষে অধিক বড়ো। গায়ের প্রত্যেক গয়নাটি নেড়েচেড়ে বিচার করতে বসল— সেকেলে গয়না, ওজনে ভারী, সোনা খাঁটি— কিন্তু কী ফ্যাশান, মরে যাই!

ওদের গাড়িতে স্টেশন-প্ল্যাটফর্মের উলটো দিকের জানলা খোলা ছিল, সেই দিকে কুমু চেয়ে রইল, চেষ্টা করতে লাগল এদের কথা যাতে কানে না যায়। দেখতে পেলে একটা এক-পা-কাটা কুকুর তিন পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাটি শুঁকে বেড়াচ্ছে। আহা, কিছু খাবার যদি হাতের কাছে থাকত! কিছুই ছিল না। কুমু মনে মনে ভাবতে লাগল, যে-একটি পা গিয়েছে তারই অভাবে ওর যা-কিছু সহজ ছিল তার সমস্তই হয়ে গেল কঠিন। এমন সময় কুমুর কানে গেল সেলুন-গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একজন ভদ্রলোক বলছে, “দেখুন, এই চাষির মেয়েকে আড়কাটি আসাম চা-বাগানে ভুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, পালিয়ে এসেছে; গোয়ালন্দ পর্যন্ত টিকিটের টাকা আছে, ওর বাড়ি দুমরাঁও, যদি সাহায্য করেন তো এই মেয়েটি বেঁচে যায়।” সেলুন-গাড়ি থেকে একটা মস্ত তাড়ার আওয়াজ কুমু শুনতে পেলে। সে আর থাকতে পারলে না, তখনই ডান দিকের জানলা খুলে তার পুঁতিগাঁথা থলে উজাড় করে দশ টাকা মেয়েটির হাতে দিয়েই জানলা বন্ধ করে দিলে। দেখে একজন মেয়ে বলে উঠল, “আমাদের বউয়ের দরাজ হাত দেখি!” আর-একজন বললে, “দরাজ নয় তো দরজা, লক্ষ্মীকে বিদায় করবার।” আর-একজন বললে, “টাকা ওড়াতে শিখেছে, রাখতে শিখলে কাজে লাগত।” এটাকে ওরা দেমাক বলে ঠিক করলে— বাবুরা যাকে এক পয়সা দিলে না, ইনি তাকে অমনি ঝনাৎ করে টাকা ফেলে দেন, এত কিসের গুমোর! ওদের মনে হল এও বুঝি সেই চাটুজ্যে-ঘোষালদের চিরকেলে রেষারেষির অঙ্গ।