প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
|
![]() |
বিশু। ঘরে ঢুকে কী দেখলে?
নন্দিনী। ওর বাঁ হাতের উপর বাজপাখি বসে ছিল; তাকে দাঁড়ের উপর বসিয়ে ও আমার মুখে চেয়ে রইল। তার পরে যেমন বাজপাখির পাখার মধ্যে আঙুল চালাচ্ছিল তেমনি করে আমার হাত নিয়ে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। একটু পরে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলে, ‘আমাকে ভয় করে না’? আমি বললুম, ‘একটুও না’। তখন আমার খোলা চুলের মধ্যে দুই হাত ভরে দিয়ে কতক্ষণ চোখ বুজে বসে রইল।
বিশু। তোমার কেমন লাগল?
নন্দিনী। ভালো লাগল। কিরকম বলব? ও যেন হাজার বছরের বটগাছ, আমি যেন ছোট্ট পাখি। ওর ডালের একটি ডগায় কখনো যদি একটু দোল খেয়ে যাই নিশ্চয় ওর মজ্জার মধ্যে খুশি লাগে। ঐ একলা প্রাণকে সেই খুশিটুকু দিতে ইচ্ছে করে।
বিশু। তার পরে ও কী বললে?
নন্দিনী। একসময় ঝেঁকে উঠে ওর বর্শাফলার মতো দৃষ্টি আমার মুখের উপর রেখে হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমি তোমাকে জানতে চাই।’ আমার কেমন গা শিউরে উঠল। বললুম, ‘জানবার কী আছে? আমি কি তোমার পুঁথি।’ সে বললে, ‘পুঁথিতে যা আছে সব জানি, তোমাকে জানি নে।’ তার পরে কিরকম ব্যগ্র হয়ে উঠে বললে, ‘রঞ্জনের কথা আমাকে বলো। তাকে কিরকম ভালোবাস।’ আমি বললুম, ‘জলের ভিতরকার হাল যেমন আকাশের উপরকার পালকে ভালোবাসে— পালে লাগে বাতাসের গান, আর হালে জাগে ঢেউয়ের নাচ।’ মস্ত একটা লোভী ছেলের মতো একদৃষ্টে তাকিয়ে চুপ করে শুনলে। হঠাৎ চমকিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘ওর জন্যে প্রাণ দিতে পার?’ আমি বললুম, ‘এখ্খনি।’ ও যেন রেগে গর্জন করে বললে, ‘কখ্খনো না।’ আমি বললুম, ‘হাঁ পারি।’ ‘তাতে তোমার লাভ কী।' বললুম, ‘জানি নে।’ তখন ছটফট করে বলে উঠল, ‘যাও, আমার ঘর থেকে যাও,যাও কাজ নষ্ট কোরো না।’ মানে বুঝতে পারলুম না।
বিশু। সব কথার পষ্ট মানে ও জানতে চায়। যেটা ও বুঝতে পারে না, সেটাতে ওর মন ব্যাকুল করে দেয়, তাতেই ও রেগে ওঠে।
নন্দিনী। পাগলভাই, ওর উপর দয়া হয় না তোমার?
বিশু। যেদিন ওর’পরে বিধাতার দয়া হবে, সেদিন ও মরবে।
নন্দিনী। না না, তুমি জান না, বেঁচে থাকবার জন্যে ও কিরকম মরিয়া হয়ে আছে।
বিশু। ওর বাঁচা বলতে কী বোঝায়, সে তুমি আজই দেখতে পাবে — জানি নে সইতে পারবে কি না।
নন্দিনী। ঐ দেখো পাগলভাই, ঐ ছায়া। নিশ্চয় সর্দার আমাদের কথা লুকিয়ে শুনেছে।
বিশু। এখানে তো চার দিকেই সর্দারের ছায়া, এড়িয়ে চলবার জো কী? — সর্দারকে কেমন লাগে?
নন্দিনী। ওর মতো মরা জিনিস দেখি নি। যেন বেতবন থেকে কেটে আনা বেত। পাতা নেই, শিকড় নেই, মজ্জায় রস নেই, শুকিয়ে লিকলিক করছে।
বিশু। প্রাণকে শাসন করবার জন্যেই প্রাণ দিয়েছে দুর্ভাগা।
নন্দিনী। চুপ করো, শুনতে পাবে।
বিশু। চুপ করাটাকেও যে শুনতে পায়, তাতে আপদ আরো বাড়ে। যখন খোদাইকরদের সঙ্গে থাকি তখন কথায়-বার্তায় সর্দারকে সামলে চলি। তাই ওরা আমাকে অপদার্থ বলে অশ্রদ্ধা করেই বাঁচিয়ে রেখেছে। ওদের দণ্ডটা দিয়েও আমাকে ছোঁয় না।