রক্তকরবী

চন্দ্রা। কেন।

বিশু। সংখ্যারূপে ওদের হিসাবের খাতায় আমরা জায়গা পাই, কিন্তু সংখ্যার অঙ্কের সঙ্গে নারীর অঙ্ক গণিতশাস্ত্রের যোগে মেলে না।

চন্দ্রা। ওমা! ওদের নিজের ঘরে কি স্ত্রী নেই। তারা কী বলে।

বিশু। তারাও সোনার তালের মদে বেহুঁশ। নেশায় স্বামীদের ছাড়িয়ে যায়। আমরা তাদের চোখেই পড়ি নে।

চন্দ্রা। বিশুবেয়াই, তোমার ঘরে তো স্ত্রী ছিল, তার হল কী। অনেকদিন খবর পাই নি।

বিশু। যতদিন চরের উচ্চপদে ভরতি ছিলুম, সর্দারনীদের কোঠাবাড়িতে তার তাসখেলার ডাক পড়ত। যখন ফাগুলালদের দলে যোগ দিলুম, ওপাড়ায় তার নেমন্তন্ন বন্ধ হয়ে গেল। সেই ধিক্কারে আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে।

চন্দ্রা। ছি, এমন পাপও করে!

বিশু। এ পাপের শাস্তিতে আর-জন্মে সে সর্দারনী হয়ে জন্মাবে।

চন্দ্রা। বিশুবেয়াই, দেখো, দেখো, ঐ কারা ধুম করে চলেছে। সারে সারে ময়ূরপঙ্খি, হাতির হাওদায় ঝালর দেখেছ! ঝলমল করছে। কী চমৎকার ঘোড়সওয়ার! বর্শার ডগায় যেন এক-এক-টুকরো সূর্যের আলো বিঁধে নিয়ে চলেছে।

বিশু। ঐ তো সর্দারনীরা ধ্বজাপূজার ভোজে যাত্রা করেছে।

চন্দ্রা। আহা, কী সাজের ধুম! কী চেহারা! আচ্ছা বেয়াই, যদি কাজ ছেড়ে না দিতে, তুমিও ওদের দলে অমনি ধুম করে বেরতে? আর তোমার সেই স্ত্রী—

বিশু। হাঁ, আমাদেরও ঐ দশা ঘটত।

চন্দ্রা। এখন আর ফেরবার পথ নেই? একেবারে না?

বিশু। আছে, নর্দমার ভিতর দিয়ে।

নেপথ্যে। পাগলভাই!

বিশু। কী পাগলি!

ফাগুলাল। ঐ তোমার নন্দিনীর ডাক পড়ল। আজকের মতো বিশুদাদাকে আর পাওয়া যাবে না।

চন্দ্রা। তোমার বিশুদাদার আশা আর রেখো না। কোন্‌ সুখে ও তোমাকে ভুলিয়েছে বলো দেখি, বেয়াই।

বিশু। ভুলিয়েছে দুঃখে।

চন্দ্রা। বেয়াই অমন উলটিয়ে কথা কও কেন।

বিশু। তোরা বুঝবি নে। এমন দুঃখ আছে যাকে ভোলার মতো দুঃখ আর নেই।

ফাগুলাল। বিশুদাদা, পষ্ট করে কথা বলো, নইলে রাগ ধরে।

বিশু। বলছি শোন্‌, কাছের পাওনাকে নিয়ে বাসনার যে দুঃখ তাই পশুর, দূরের পাওনাকে নিয়ে আকাঙ্ক্ষার যে দুঃখ তাই মানুষের। আমার সেই চিরদুঃখের দূরের আলোটি নন্দিনীর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।

চন্দ্রা। এ-সব কথা বুঝি নে বেয়াই, একটা কথা বুঝি যে, যে মেয়েকে তোমরা যত কম বোঝ সেই তোমাদের তত বেশি টানে। আমরা সাদাসিধে, আমাদের দর কম, তবু যা হোক তোমাদের সোজা পথে নিয়ে চলি। কিন্তু আজ বলে রাখলুম, ঐ মেয়েটা ওর রক্তকরবীর মালার ফাঁসে তোমাকে সর্বনাশের পথে টেনে আনবে।

[চন্দ্রা ও ফাগুলালের প্রস্থান