প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
|
![]() |
ইতিমধ্যে কিছুদূরে আমাদের অর্ধসমাপ্ত কয়লার খনিতে মজুরদের হল স্ট্রাইক। ঘটালেন যিনি, এই তাঁর ব্যাবসা, স্বভাব এবং অভাব বশত; সমস্ত কাজের মধ্যে এইটেই সব চেয়ে সহজ। কোনো কারণ ছিল না, কেননা আমি নিজে সোশালিস্ট, সেখানকার বিধিবিধান আমার নিজের হাতে বাঁধা, কারো সেখানে না ছিল লোকসান, না ছিল অসম্মান।
নূতন যন্ত্র এসেছে জর্মনি থেকে, তারই খাটাবার চেষ্টায় ব্যস্ত আছি। এমনসময় উত্তেজিত ভাবে এসে উপস্থিত অচিরা। বললে, “আপনি মোটা মাইনে নিয়ে ধনিকের নায়েবি করছেন, এদিকে গরিবের দারিদ্র্যের সুযোগটাকে নিয়ে আপনি—”
চন্ করে উঠল মাথা। বাধা দিয়ে বললুম, “কাজ চালাবার দায়িত্ব এবং ক্ষমতা যাদের তারাই অন্যায়কারী, আর জগতে যারা কোনো কাজই করে না, করতে পারেও না, দয়ামায়া কেবল তাদেরই— এই সহজ অহংকারের মত্ততায় সত্যমিথ্যার প্রমাণ নিতেও মন চায় না।”
অচিরা বললে, “সত্য নয় বলতে চান? ”
আমি বললুম, “সত্য শব্দটা আপেক্ষিক। যা কিছু যত ভালোই হোক, তার চেয়ে আরো ভালো হতেও পারে। এই দেখুন-না আমার মোটা মাইনে বটে, তার থেকে মাকে পাঠাই পজ্ঞাশ, নিজে রাখি ত্রিশ, আর বাকি— সে হিসেবটা থাক্। কিন্তু মার জন্যে পনেরো নিজের জন্যে পাঁচ রাখলে আইডিয়ালের আরো কাছ ঘেঁষে যেত, কিন্তু একটা সীমা আছে তো।”
অচিরা বললে, “সীমাটা কি নিজের ইচ্ছের উপরেই নির্ভর করে।”
আমি বললুম, “না, অবস্থার উপরে। যে কথাটা উঠল সেটা একটু বিচার করে দেখুন। য়ুরোপে ইণ্ডস্ট্রীয়ালিজ্ম্ গড়ে উঠেছে দীর্ঘকাল ধরে। যাদের হাতে টাকা ছিল এবং টাকা করবার প্রতিভা ছিল তারাই এটা গড়েছে। গড়েছে নিছক টাকার লোভে, সেটা ভালো নয় তা মানি। কিন্তু ঐ ঘুষটুকু যদি না পেত তা হলে একেবারে গড়াই হত না, এতদিন পরে আজ ওখানে পড়েছে হিসেবনিকেশের তলব।”
অচিরা বললে, “আপনি বলতে চান পায়ে তেল শুরুতে, কানমলা তার পরে? ”
“নিশ্চয়। আমাদের দেশে ভিত-গাঁথা সবে আরম্ভ হয়েছে এখনই যদি মার লাগাই তা হলে শুরুতেই হবে শেষ, সুবিধে হবে বিদেশী বণিকদের। মানছি আজ আমি লোভীদের ঘুষ দেওয়ার কাজ নিয়েছি, টাকাওয়ালার নায়েবি আমি করি। আজ সেলাম করছি বাদশার দরবারে এসে, কাল ওদের সিংহাসনের পায়ায় লাগাব কুড়ুল। ইতিহাসে তো এই দেখা গেছে।”
অচিরা বললে, “সব বুঝলুম। কিন্তু আমি দিনের পর দিন অপেক্ষা করে আছি দেখতে, এই স্ট্রাইক মেটাতে আপনি নিজে কবে যাবেন। নিশ্চয়ই আপনাকে ডাকাও পড়েছিল। কিন্তু কেন যান নি? ”
চাপা গলায় বলতে চেষ্টা করলুম, “এখানে কাজ ছিল বিস্তর।” কিন্তু ফাঁকি দেব কী করে। আমার ব্যবহারে তো আমার কৈফিয়তের প্রমাণ হয় না।
কঠিন হাসি হেসে দ্রুতপদে চলে গেল অচিরা।
আর চলবে না। একটা শেষ নিষ্পত্তি করাই চাই। নইলে অপমানের অন্ত থাকবে না।