প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
|
![]() |
“নিজের বুদ্ধিতে না। একটা তোমার মহদ্গুণ আছে, কখন কাকে কী যে বল, ভোলানাথ তুমি সব ভুলে যাও। তাই চোরাই মালের উপর নিজের ছাপ লাগিয়ে দিতে ভাবনা থাকে না।”
আমি বললুম, “নিজের ছাপ যদি লাগে তা হলেই অপরাধ খণ্ডন হয়।”
“জানেন, নবীনবাবু, ওঁর কত ছাত্র ওঁর কত মুখের কথা খাতায় টুকে নিয়ে বই লিখে নাম করেছে। উনি তাই পড়ে আশ্চর্য হয়ে প্রশংসা করেছেন, বুঝতেই পারেন নি নিজের প্রশংসা নিজেই করছেন। কোন্ কথা আমার কথা আর কোন্ কথা ওঁর নিজের সে ওঁর মনে থাকে না— লোকের সামনে আমাকে বলে বসেন ওরিজিন্যাল, তখন সেটার প্রতিবাদ করার মতো মনের জোর পাওয়া যায় না। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি নবীনবাবুরও এ ভ্রম ঘটছে। কী করবো বলো, আমি তো কোটেশন মার্কা দিয়ে দিয়ে কথা বলতে পারি নে।”
“নবীনবাবুর এ ভ্রম কোনোদিন ঘুচবে না।”
অচিরা বললে, “দাদু একদিন আমাদের কলেজ-ক্লাসে কচ ও দেবযানীর ব্যাখ্যা করছিলেন। কচ হচ্ছে পুরুষের প্রতীক, আর দেবযানী মেয়ের। সেই দিন নির্মম পুরুষের মহৎ গৌরব মনে মনে মেনেছি, মুখে কক্খনো স্বীকার করি নে।”
অধ্যাপক বললেন, “কিন্তু দিদি, আমার কোনো কথায় মেয়েদের গৌরবের আমি কোনোদিন লাঘব করি নি।”
“তুমি আবার করবে। হায় রে। মেয়েদের তুমি যে অন্ধ ভক্ত। তোমার মুখের স্তবগান শুনে মনে মনে হাসি। মেয়েরা নির্লজ্জ হয়ে সব মেনে নেয়। তার উপরেও বুক ফুলিয়ে সতীসাধ্বীগিরির বড়াই করে নিজের মুখে। সস্তায় প্রশংসা আত্মসাৎ করা ওদের অভ্যেস হয়ে গেছে।”
অধ্যাপক বলেলেন, “না দিদি, অবিচার কোরো না। অনেক কাল ওরা হীনতা সহ্য করেছে, হয়তো সেইজন্যেই নিজেদের শ্রেষ্ঠতা নিয়ে একটু বেশি জোর দিয়ে তর্ক করে।”
“না, দাদু, ও তোমার বাজে কথা। আসল হচ্ছে এটা স্ত্রীদেবতার দেশ— এখানে পুরুষেরা, স্ত্রৈণ মেয়েরাও স্ত্রৈণ। এখানে পুরুষরা কেবলই ‘মা মা’ করছে, আর মেয়েরা চিরশিশুদের আশ্বাস দিচ্ছে যে তারা মায়ের জাত। আমার তো লজ্জা করে। পশু-পক্ষীদের মধ্যেও মায়ের জাত নেই কোথায়? ”
চিত্তচাঞ্চল্যে কাজের এত বাধা ঘটছে যে লজ্জা পাচ্ছি মনে মনে। সদরে বাজেটের মিটিঙে রিসর্চবিভাগে আরো কিছু দান মঞ্জুর করিয়ে নেবার প্রস্তাব ছিল। তার সমর্থক রিপোর্টখানা অর্ধেকের বেশি লেখাই হয় নি। অথচ এদিকে ক্রোচের এস্থেটিক্স্ নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা শুনে আসছি। অচিরা নিশ্চিত জানে বিষয়টা আমার উপলব্ধি ও উপভোগের সম্পূর্ণ বাইরে। তা হলেও চলত, কিন্তু আমার বিশ্বাস ব্যাপারটাকে সে ইচ্ছে করে শোচনীয় করে তুলেছে। ঠিক এই সময়টাতেই সাঁওতালদের পার্বণ। তারা পচাই মদ খাচ্ছে আর মাদল বাজিয়ে মেয়েপুরুষে নৃত্য করছে। অচিরা ওদের পরম বন্ধু। মদের পয়সা জোগায়, সালু কিনে দেয় সাঁওতাল ছেলেদের কোমরে বাঁধবার জন্যে, বাগান থেকে জবাফুলের জোগান দেয় সাঁওতাল মেয়েদের চুলে পরবার। ওকে না হলে তাদের চলেই না। অচিরা অধ্যাপককে বলেছে, ও তো এ কদিন থাকতে পারবে না অতএব এই সময়টাতে বিরলে আমাকে নিয়ে ক্রোচের রসতত্ত্ব যদি পড়ে শোনান তা হলে আমার সময় আনন্দে কাটবে। একবার সসংকোচে বলেছিলুম, ‘সাঁওতালদের উৎসব দেখতে আমার বিশেষ কৌতূহল আছে।’ স্বয়ং অধ্যাপক বললেন, না, সে আপনার ভালো লাগবে না। আমার ইনটেলেক্চুয়ল মনোবৃত্তির নির্জলা একান্ততার ’পরে তাঁর এত বিশ্বাস। মধ্যাহ্নভোজনের পরেই অধ্যাপক গুন গুন করে পড়ে চলেছেন। দূরে মাদলের আওয়াজ এক-একবার থামছে। পরক্ষণেই দ্বিগুণ জোরে বেজে উঠছে। কখনো বা পদশব্দ কল্পনা করছি, কখনো বা হতাশ হয়ে ভাবছি অসমাপ্ত রিপোর্টের কথা।