রক্তকরবী

নেপথ্যে। সুন্দরের জবাব সুন্দরই পায়। অসুন্দর যখন জবাব ছিনিয়ে নিতে চায়, বীণার তার বাজে না, ছিঁড়ে যায়। আর নয়, যাও তুমি চলে যাও – নইলে বিপদ ঘটবে।

নন্দিনী। যাচ্ছি, কিন্তু বলে গেলুম, আজ আমার রঞ্জন আসবে, আসবে, আসবে – কিছুতে তাকে ঠেকাতে পারবে না।

[ প্রস্থান
ফাগুলাল খোদাইকর ও তার স্ত্রী চন্দ্রার প্রবেশ

ফাগুলাল। আমার মদ কোথায় লুকিয়েছ চন্দ্রা, বের করো।

চন্দ্রা। ওকি কথা। সকাল থেকেই মদ?

ফাগুলাল। আজ ছুটির দিন। কাল ওদের মারণচণ্ডীর ব্রত গেছে। আজ ধ্বজাপূজা, সেই সঙ্গে অস্ত্রপূজা।

চন্দ্রা। বল কী। ওরা কি ঠাকুরদেবতা মানে!

ফাগুলাল। দেখ নি ওদের মদের ভাঁড়ার, অস্ত্রশালা আর মন্দির একেবারে গায়ে গায়ে?

চন্দ্রা। তা ছুটি পেয়েছ বলেই মদ? গাঁয়ে থাকতে পার্বণের ছুটিতে তো –

ফাগুলাল। বনের মধ্যে পাখি ছুটি পেলে উড়তে পায়, খাঁচার মধ্যে তাকে ছুটি দিলে মাথা ঠুকে মরে। যক্ষপুরে কাজের চেয়ে ছুটি বিষম বালাই।

চন্দ্রা। কাজ ছেড়ে দাও-না, চলো-না ঘরে ফিরে।

ফাগুলাল। ঘরের রাস্তা বন্ধ, জান না বুঝি?

চন্দ্রা। কেন বন্ধ।

ফাগুলাল। আমাদের ঘর নিয়ে ওদের কোনো মুনফা নেই।

চন্দ্রা। আমরা কি ওদের দরকারের গায়ে আঁট করে লাগানো, যেন ধানের গায়ে তুঁষ? ফালতো কিছুই নেই?

ফাগুলাল। আমাদের বিশুপাগল বলে, আস্ত হয়ে থাকাটা কেবল পাঁঠার নিজের পক্ষেই দরকার; যারা তাকে খায়, তার হাড়গোড় খুরলেজ বাদ দিয়েই খায়। এমন-কি, হাড়কাঠের সামনে তারা যে ভ্যাঁ করে ডাকে, সেটাকেও বাহুল্য বলে আপত্তি করে। ঐ-যে বিশুপাগল গান গাইতে গাইতে আসছে।

চন্দ্রা। কিছুদিন থেকে হঠাৎ ওর গান খুলে গেছে।

ফাগুলাল। তাই তো দেখছি।

চন্দ্রা। ওকে নন্দিনীতে পেয়েছে, সে ওর প্রাণ টেনেছে, গানও টেনেছে।

ফাগুলাল। তাতে আর আশ্চর্যটা কী।

চন্দ্রা। না, আশ্চর্য কিছুই নেই। ওগো সাবধান থেকো, কোন্‌ দিন তোমারও গলা থেকে গান বের করবে — সেদিন পাড়ার লোকের কী দশা হবে। মায়াবিনী মায়া জানে। বিপদ ঘটাবে।

ফাগুলাল। বিশুর বিপদ আজ ঘটে নি, এখানে আসবার অনেক আগে থাকতেই ও নন্দিনীকে জানে।

চন্দ্রা। বিশুবেয়াই, শুনে যাও, শুনে যাও। যাও কোথায়। গান শোনাবার লোক এখানেও এক-আধজন মিলতে পারে, নিতান্ত লোকসান হবে না।