প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
|
![]() |
উত্তর এল, ‘পাকা দেয়াল তোলা হয়ে গেছে, রাস্তা বন্ধ। তার পরেও লোকটার মতিগতি সম্বন্ধে যদি কৌতূহল থাকে তবে শোনো। এ দেশে থাকতে আমি যাঁর ছাত্র ছিলুম তাঁর নাম নাই জানলে। তিনি পরম পণ্ডিত আর ঋষিতুল্য লোক। তাঁর নাতনিটিকে যদি দেখ তা হলে জানবে সরস্বতী কেবল যে আবির্ভূত হয়েছেন অধ্যাপকের বিদ্যামন্দিরে তা নয় তিনি দেহ নিয়ে এসেছেন তাঁর কোলে। এমন বুদ্ধিতে উজ্জ্বল অপরূপ সুন্দর চেহারা কখনো দেখি নি।’
‘ভবতোষ ঢুকল শয়তান তাঁর স্বর্গলোকে। স্বল্পজল নদীর মতো বুদ্ধি তার অগভীর বলেই জ্বল্জ্বল্ করে আর সেইজন্যেই তার বচনের ধারা অনর্গল। ভুললেন অধ্যাপক, ভুললেন নাতনি। রকমসকম দেখে আমাদের তো হাত নিস্পিস্ করতে থাকত। কিছু বলবার পথ ছিল না— বিবাহের সম্বন্ধ পাকাপাকি, বিলেত গিয়ে সিভিলিয়ান হয়ে আসবে তারই ছিল অপেক্ষা। তারও পাথেয় এবং খরচ জুগিয়েছেন কন্যার পিতা। লোকটার সর্দির ধাত, একান্ত মনে কামনা করেছিলুম ন্যুমোনিয়া হবে। হয় নি। পাস করলে পরীক্ষায়; দেশে ফেরবামাত্র বিয়ে করলে ইণ্ডিয়া গবর্মেন্টের উচ্চপদস্থ মুরব্বির মেয়েকে। লোকসমাজে নাতনির লজ্জা বাঁচাবার জন্যে মর্মাহত অধ্যাপক কোথায় অন্তর্ধান করেছেন জানি নে। অনতিকালের মধ্যে ভবতোষের অপ্রত্যাশিত পদোন্নতির সংবাদ এল। মস্ত একটা বিদায়ভোজের আয়োজন হল। শুনেছি খরচটা দিয়েছে ভবতোষ গোপনে নিজের পকেট থেকে। আমরাও নিজের পকেট থেকেই খরচ দিয়ে গুণ্ডা লাগিয়ে ভোজটা দিলুম লণ্ডভণ্ড করে। কাগজে কংগ্রেসওয়ালাদের প্রতিই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল ভবতোষেরই ইশারায়। আমি জানি এই সৎকার্যে তারা লিপ্ত ছিল না। যে নাগরা জুতো লেগেছিল পলায়মানের পিঠে, সেটা অধ্যাপকেরই এক প্রাক্তন ছাত্রের প্রশস্ত পায়ের মাপে। পুলিস এল গোলমালের অনেক পরে— ইনস্পেক্টর আমার বন্ধু, লোকটা সহৃদয়।’
চিঠিখানা পড়লুম, প্রাক্তন ছাত্রটির প্রতি ঈর্ষা হল।
অচিরার সঙ্গে প্রথম কথাটি শুরু করাই সব চেয়ে কঠিন কাজ। আমি বাঙালি মেয়েকে ভয় করি। বোধ করি চেনা নেই বলেই। অথচ কাজে যোগ দেবার কিছু আগেই কলকাতায় কাটিয়ে এসেছি। সিনেমামঞ্চপথবর্তিনী বাঙালি মেয়ের নতুন চাষ করা ভ্রূবিলাস দেখে তো স্তম্ভিত হয়েছি— তারা সব জাতবান্ধবী— থাক্ তাদের কথা। কিন্তু অচিরাকে দেখলুম একালের ঠেলাঠেলি ভিড়ের বাইরে— নির্মল আত্মমর্যাদায়, স্পর্শভীরু মেয়ে। আমি তাই ভাবছি প্রথম কথাটি শুরু করব কী করে।
জনরব এই যে কাছাকাছি ডাকাতি হয়ে গেছে। ভাবলুম, হিতৈষী হয়ে বলি ‘রাজা-বাহাদুরকে ব’লে আপনার জন্যে পাহারার বন্দোবস্ত করে দিই।’ ইংরেজ মেয়ে হলে হয়তো গায়েপড়া আনুকূল্য সইতে পারত না, মাথা বাঁকিয়ে বলত, ‘সে ভাবনা আমার।’ এই বাঙালি মেয়ে অচেনার কাছ থেকে কী ভাবে কথাটা নেবে আমার জানা নেই, হয়তো আমাকেই ডাকাত ব’লে সন্দেহ করবে।
ইতিমধ্যে একটা ঘটনা ঘটল সেটা উল্লেখযোগ্য।
দিনের আলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। অচিরার সময় হয়েছে ঘরে ফেরবার। এমন সময় একটা হিন্দুস্থানী গোঁয়ার এসে তার হাত থেকে তার খাতা আর থলিটা নিয়ে যখন ছুটেছে আমি তখনই বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বললুম, “কোনো ভয় নেই আপনার”। এই বলে ছুটে সেই লোকটার ঘা ড়ের উপর পড়তেই সে ব্যাগ খাতা ফেলে দৌড় মারলে। আমি লুঠের মাল নিয়ে এসে অচিরাকে দিলুম। অচিরা বললে, “ভাগ্যিস আপনি—”
আমি বললেম, “আমার কথা বলবেন না, ভাগ্যিস ঐ লোকটা এসেছিল।”
“তার মানে?”
“তার মানে তারই কৃপায় আপনার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়ে গেল।”
অচিরা বিস্মিত হয়ে বললে, “কিন্তু ও যে ডাকাত! ”