প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
“মনে রাখিস মস্ত প্রতিভার মস্ত দায়িত্ব। ও তো কারও নিজের জিনিস নয়। ওর জবাবদিহি অনন্তকালের কাছে। শুনছ সুহি, শুনছ? কথাটা কেমন বলেছি বলো তো ভাই।”
“খুব ভালো বলেছেন। আগেকার দিনের রাজা থাকলে গলা থেকে মালা খুলে—”
“তারা তো মরেছে সব, কিন্তু—”
“ঐ কিন্তুটুকু মরে নি, মনে থাকবে।”
রেবতী বললে, “ভয় নেই, কিছুতে আমাকে দুর্বল করবে না।”
সোহিনীকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গেল। সোহিনী তাড়াতাড়ি আটকিয়ে দিলে।
চৌধুরী বললেন, “আরে করলে কী। পুণ্যকর্ম না করার দোষ আছে, পুণ্যকর্মে বাধা দেওয়ার দোষ আরো বেশি।”
সোহিনী বললে, “প্রণাম যদি করতে হয় তো ঐখানে।” — ব’লে বেদীর উপরে বসানো নন্দকিশোরের মূর্তি দেখিয়ে দিলে। ধূপধুনো জ্বলছে, ফুলে ভরে আছে থালা।
বললে, “পাতকীকে উদ্ধার করার কথা পুরাণে পড়েছি। আমাকে উদ্ধার করেছেন ঐ মহাপুরুষ। অনেক নীচে নামতে হয়েছিল, শেষকালে তুলে বসাতে পেরেছেন— পাশে বললে মিথ্যে হবে, তাঁর পায়ের তলায়। বিদ্যার পথে মানুষকে উদ্ধার করবার দীক্ষা তিনি আমাকে দিয়ে গেছেন। বলে গিয়েছেন যেন মেয়েজামাইয়ের গুমর বাড়াবার জন্যে তাঁর জীবনের খনিখোঁড়া রত্ন ছাইয়ের গাদায় হারিয়ে না ফেলি। বললেন, ‘ঐখানে রেখে গেলেম আমার সদ্গতি, আর সদ্গতি আমার দেশের’।”
অধ্যাপক বললেন, “শুনলি তো রেবু? এটা হবে ট্রাস্ট সম্পত্তি, তোকে দেওয়া হবে তার কর্তৃত্ব।”
রেবতী ব্যস্ত হয়ে বললে, “কর্তৃত্ব নেবার যোগ্য আমি নই। আমি পারব না।”
সোহিনী বললে, “পারবে না! ছি, এ কি পুরুষের মতো কথা।”
রেবতী বললে, “আমি চিরদিন পড়াশুনো করে এসেছি, এরকম কাজের ভার কখনো নিই নি।”
চৌধুরী বললেন, “ডিম ফোটাবার আগে কখনো হাঁস সাঁতার দেয় নি। আজ তোমার ডিমের খোলা ভাঙবে।”
সোহিনী বললে, “ভয় নেই তোমার, আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকব।”
রেবতী আশ্বস্ত হয়ে চলে গেল।
সোহিনী অধ্যাপকের মুখের দিকে চেয়ে রইল। চৌধুরী বললেন, “জগতে বোকা অনেকরকম আছে, পুরুষ বোকা সকল বোকার সেরা। কিন্তু মনে রেখো, দায়িত্ব হাতে না পেলে দায়িত্বের যোগ্যতা জন্মায় না। একজোড়া হাত পেয়েছে মানুষ তাই সে হয়েছে মানুষ, একজোড়া খুর পেলেই তার সঙ্গে সঙ্গে মলবার যোগ্য লেজ আপনি গজিয়ে উঠত। তুমি কি রেবতীর হাতের বদলে খুর দেখতে পেয়েছ নাকি।”
“না, আমার ভালো লাগছে না। মেয়ের হাতেই যারা মানুষ কোনো কালে তাদের দুধে-দাঁত ভাঙে না। কপাল আমার। আপনি থাকতে আমি আর-কারও কথা কেন ভাবতে গেলুম।”
“খুশি হলুম শুনে। একটুখানি বুঝিয়ে দাও কী গুণ আছে আমার।”
“লোভ নেই আপনার একটুও।”
“এত বড়ো নিন্দের কথা! লোভের মতো জিনিসকে লোভ করি নে?— খুবই করি—”
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তাঁর দুই গালে দুই চুমো দিয়ে সোহিনী সরে গেল।
“কোন্ খাতায় জমা হল এটা সোহিনী।”
“আপনার কাছে যে ঋণ পেয়েছি সে তো শোধ করতে পারি নে, তারই সুদ দিচ্ছি।”
“প্রথম দিন পেয়েছি একটি, আজ পেলুম দুটি। কেবলই বেড়ে চলবে নাকি।”
“বাড়বে বৈকি, চক্রবৃদ্ধির নিয়মে।”