অসংখ্য জগৎ
উপরের কথাটাকে আরো একটু বিস্তৃত করা যাক। একজন লোক মরিয়া গেল,আমরা সাধারণত মনে করি সেই গেল, তাহার সহিত আর কিছু গেল না। এরূপ ভ্রমে পড়িবার প্রধান কারণ এই যে, আমরা সচরাচর মনে করি যে,সেও যে জগতে আছে আমরাও সেই জগতে আছি,সেও যাহা দেখিতেছে আমরাও তাহাই দেখিতেছি। কিন্তু সেই অনুমানটাই ভ্রম নাকি, এই নিমিত্ত সমস্ত যুক্তিতে ভ্রম পৌঁছিয়াছে। সে যাহা দেখিতেছে আমরা তাহা দেখিতেছি না, সে যেখানে আছে আমরা সেখানে নাই। সে দেখিতেছে, ভাগীরথী পতিমিলনাশয়ে চঞ্চলা যুবতীর ন্যায় নৃত্য করিতেছে,গান গাহিতেছে; আমি দেখিতেছি ভাগীরথী স্নেহময়ী মাতার ন্যায় তটভূমিকে স্তন্যপান করাইতেছেন, তরঙ্গহস্তে অনবরত তাহার ললাটে অভিঘাত করিয়া কলকন্ঠে বৈচিত্র্যহীন ঘুম পাড়াইবার গান গাহিতেছেন। উভয় জগতের উভয় জাহ্নবীর মধ্যে এত প্রভেদ। এই প্রকার, যত লোক আছে সকল লোকেরই জগৎ স্বতন্ত্র। লোক অর্থে, মনুষ্য বিশেষ এবং লোক অর্থে জগৎ বুঝায়। অর্থাৎ একজন মনুষ্য বলিলে একটি জগৎ বলা হয়। আমি কে? না, আমি যাহা কিছু দেখিতেছি — চন্দ্র সূর্য পৃথিবী ইত্যাদি — সমস্ত লইয়া একজন। তুমিও তাহাই। অতএব প্রতি লোকের সঙ্গে সঙ্গে শত শত চন্দ্র সূর্য জন্মগ্রহণ করে ও শত শত চন্দ্র সূর্য মরিয়া যায়। অতএব দেখ, জগৎ যেমন অসংখ্য তেমনি বিচিত্র। কাহারও জগতে সূর্যোদয় আছে, আঁধারের অপগমন ও আলোকের আগমন আছে, কিন্তু প্রভাত নাই। সে ব্যক্তি সূর্যোদয়-রূপ একটা ঘটনা দেখিতে পায় বটে, কিন্তু প্রভাত দেখিতে পায় না। প্রভাত-শিশির, প্রভাত-সমীরণ, প্রভাত-মেঘমালা,প্রভাত-অরুণরাগের সামঞ্জস্য দেখিতে পায় না; সুতরাং তাহার জগতে প্রভাত ব্যতীত প্রভাতের আর সমস্তই আছে। কাহারও বা প্রভাত আছে,সন্ধ্যা নাই। বসন্ত আছে,শরৎ নাই। কাহারও জ্যোৎস্না হাসে, কাহারও জ্যোৎস্না কাঁদে। কাহারও জগতে টাকার ঝম্ঝম্ ব্যতীত সঙ্গীত নাই, মলের ঝম্ঝম্ ব্যতীত কবিতা নাই, উদরের বাহিরে সুখ নাই, ইন্দ্রিয়ের বাহিরে অস্তিত্ব নাই। এমন কত কহিব! এ সকল তো স্পষ্ট প্রভেদ; সূক্ষ প্রভেদ কত আছে, তাহার নাম কে করিবে?