প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
আপনারা সকলে এই আশ্রমে স্বার্থবলিদান করিয়া বাস করিতেছেন। আপনারা ‘সত্য’ কী তাহা উপলদ্ধি করিতে পারিয়াছেন। প্রবৃত্তিতে মানুষকে পশু করিয়া তোলে, নিবৃতিই দেবত্ব গঠনের সহায়ক, এই ‘সত্য’ আপনারা প্রাণে প্রাণে অনুভব করিয়াছেন।
ত্যাগ কাহাকে বলে? ত্যাগের অর্থ এই যে, মানুষের দেহটাই প্রকৃত জীবন নহে, আত্মাই প্রকৃত জীবন। পশুর সহিত এই যে পার্থিব জীবন আমরা যাপন করি, এই জড় জগৎই কেবল জগৎ নহে, কিন্তু আমাদের মধ্যে ইহাপেক্ষা আরও উচ্চতর যে জীবন লুক্কায়িত আছে, সেই জীবনের জন্য আরও উচ্চতর জগতের প্রয়োজন। আমাদের সেই লুক্কায়িত জীবন অবিনশ্বর— অমর, অক্ষয়, ও অব্যয়। যে ব্যক্তি এই জড়জগতের স্বার্থকে জয় করিতে পারিয়াছে কেবল সেই-ই সেই অমর জীবন উপভোগ করিতে পারে। প্রত্যেক মানুষকে ‘দ্বিজ’ হইতে হইবে, একবার দেহ লইয়া জন্ম গ্রহণ করিতে হহিবে, আবার সত্যের আলোক লইয়া অমর জীবণের সন্ধান পাইয়া নূতন জন্ম লাভ করিতে হইবে। যাহারা আপনার মধ্যে অসীমকে উপভোগ করিতে পারে তাহারাই অমর হয়। তাহারাই জানে যে, জীবনের কখনো ধ্বংস হয় না। মুরগীর ছানা যেমন ডিম ভাঙিয়া আলোক আনে, মানুষ তেমনি আলোক আনিতে পারে— যদি সে স্বার্থের দিম্ব ভাঙিতে পারে— মানুষ যতদিন হইতে বুঝিতে পারিয়াছে যে, এই জড় জগৎই চরম জগৎ নহে, সেই দিন হইতেই মানুষ এই শৃঙ্খল ভাঙিয়া নূতন জগতের সন্ধানে ফিরিতেছে। পৃথিবীর সমস্ত ধর্মই এই অমর জগতে লোককে লইবার জন্য নানাভাবে আলোক প্রদর্শন করিতেছে। সকল ধর্মেরই উদ্দেশ্য কিন্তু অমর জগতের সন্ধান দেওয়া। সকল ধর্মই বলে ত্যাগের দ্বারা সেই অমর জগতে পৌঁছানো যায়। ত্যাগ যদি সত্য সত্য অবলম্বন করা হয় তবে তাহা অমর জগতে মানুষকে লইয়া যায়। এই ত্যাগ অবলম্বন করিতে গেলে কঠোর তপস্যা চাই। এই আশ্রমে আপনারা সেই তপস্যায় নিমগ্ন আছেন। আপনারা নিশ্চয়ই অমৃতলোকের অধিকারী হইবেন।
মহাত্মাজী আজ আপনাদের মধ্যে নাই, কিন্তু তাঁহার আত্মা আপনাদের মধ্যেই বিরাজ করিতেছে। মহাত্মাজী আত্মাকে বিশুদ্ধ করিতে বলিয়াছেন। এই আত্মশুদ্ধিতেই আপনাদের মুক্তি নিহিত। মহাত্মাজীর বাণী শুধু আপনাদের মধ্যেই আবদ্ধ নাই, তাহা বিশ্বের সর্বত্র বিস্তৃত হইয়াছে। অতএব মহাত্মাকে ‘বিশ্বকর্মা’ বলা যাইতে পারে। তিনিই অসীম, তাঁহার জ্যোতিঃ আজ সমগ্র বিশ্বে পরিব্যাপ্ত হইয়াছে। প্রতি বিশ্বমানবের হৃদয়ে মহাত্মার জন্য রত্নসিংহাসন প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। যে অসীমময়, সে অসীমকে পায়। উপনিষদের ইহাই বাণী। তাঁহাকে মনে ও বাক্যে জানিতে পারিলে বিশ্বকর্মাকে জানা হয়। জীবনটিকে বিশ্বের হিতের জন্য উৎসর্গ করিতে পারিলে সেই বিশ্ববন্ধুকে ধরা যায়। আপনাদের আশ্রমাশিক্ষাও এই আলোকদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত। ব্রহ্মা স্বয়ং ত্যাগ স্বীকার করিয়া এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করিয়াছিলেন। ত্যাগের দ্বারাই সৃষ্টি হয়— কখনো ধ্বংস হয় না। আমরা এই সত্যটুকু হৃদয়ংগম করিতে পারিলে মহাত্মার হৃদয়ের সহিত আপন হৃদয় এক যোগসূত্রে বাঁধিতে পারিব এবং তখনই প্রকৃত মহাত্মার কর্মের অংশী বলিয়া গণ্য হইব।