পরিশিষ্ট

হতভাগ্য সাঁওতালদের দুঃখ কেহ দেখিল না, তাহাদের নালিশ কেহ বুঝিল না, যখন নিতান্ত অসহ্য হইয়া তাহারা দাবানলপীড়িত মৃগযূথের ন্যায় তাহাদের অরণ্যবাসভূমি ছাড়িয়া বাহির হইয়া পড়িল, তখন রাজসৈন্যগণ তাহাদিগকে গুলিবর্ষণে দলে দলে ধূলিসাৎ করিয়া দিতে লাগিল।১ অবশেষে এই হত্যাকান্ড যখন প্রচুর সাঁওতাল-রক্তে পরিতৃপ্ত হইয়া শান্তিলাভ করিল তখন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানগণ্‌ কিরূপ ধুয়া তুলিলেন?

হান্টার-সাহেব এ সম্বন্ধে ক্যাল্‌কাটা রিভিয়ু -নামক বিখ্যাত পত্রে প্রকাশিত প্রবন্ধবিশেষের উল্লেখ কারিয়া তাঁহার 'গ্রাম্যবঙ্গবৃত্তান্ত' গ্রন্থে লিখিয়াছেন—

In short, no one knew anything about the wrongs or the peaceful industry of the Santals. They were simply “adult tigers” or “bloodthirsty savages” and the reviewer, dismissing the ordinary plan of punishing only the actual rebels as insufficient, adpots a proposal to deport across the seas, not one or two ringleaders, but the entire population of the inflicted districts.

এইরূপ অসংগত এবং অসংযত ভাষা ইংরাজ-চালিত পত্রে মধ্যে মধ্যে শুনা গিয়াছে এবং নিশ্চয়ই কালে কালে আরো শুনা যাইবে। তাহার কারণ হান্টার-সাহেব পূর্বেই নির্ণয় করিয়া বলিয়াছেন যে, তাহা আতঙ্ক; এবং ইহাও বলিয়াছেন যে, সাধারণ মনের সেই উদ্দাম আতঙ্কের প্রতিকূলে রূঢ়ভাবে ধৈর্যরক্ষা করা গবর্মেন্টের গুরুতর কর্তব্যের অঙ্গ।

আতঙ্ক যে কিরূপ দৃঢ়বদ্ধমূল এবং কত দূর অন্ধ মূঢ়তার দ্বারা বেষ্টিত তাহা সম্প্রতি-প্রকাশিত কোনো ইংরাজ পত্রের একটি প্যারাগ্রাফে স্পষ্ট ফুটিয়া উঠিয়াছে; কিছুকাল পূর্বে আমাদের গবর্মেন্ট যখন ভারতবর্ষের উপর দ্বাদশাদিত্যের মূর্তিধারণ করিয়া উঠিয়াছিলেন তখন কলিকাতার বস্‌তিবাসী ইতর -সাধারণের মধ্যেও একটা প্রকাশ্য ইংরাজবিদ্বেষ প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিয়াছিল। সম্প্রতি ঠিক তাহার উলটা ভাব দেখিয়া ইংরাজ সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সম্পূর্ণ আশ্বস্ত হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু জুজুর ভয় যুক্তির দ্বারা যায় না। সম্প্রতি একজন ইংরাজ আগন্তুককে দেখিয়া কোনো বস্‌তির অধিবাসীগণ ছোটোলাট-ভ্রমে তাঁহাকে প্রচুর ভক্তি প্রদর্শন করিয়াছিল এই প্রসঙ্গ উপলক্ষে উক্ত পত্র লিখিয়াছেন যে, ইহা হইতে স্পষ্ট প্রমাণ হইতেছে দেশের সাধারণের মনে ইংরাজ-রাজভক্তি প্রবল, কিন্তু— উহার মধ্যে জুজু-আকারে একটা 'কিন্তু' রহিয়া গেছে— কিন্তু বোধ করি কুমন্ত্রীদের উত্তেজনায় মাঝে মাঝে তাহারা বিগড়িয়া যায়।

সাহেবের হৃদয়াকাশ সম্পূর্ণ পরিষ্কার হইল না। একটা কালো রঙের খটকা রাখিয়া দিলেন। একটা কুমন্ত্রী কোনো-একটা জায়গায় নিশ্চয় আছে। এ প্রশ্ন একবার মনে উদয় হইল না যে, এক্ষণে তিনি কোথায় আছেন। হঠাৎ কেনই-বা তিনি জাগিয়া উঠেন, আবার হঠাৎ ছুটিই বা লন কেন।

জুজুর থিয়োরি ছাড়িয়া দিলেও এই রহস্যের যে একটা অত্যন্ত সরল মীমাংসা আছে সেটা কেন সাহেবের মাথায় প্রবেশ করিল না। কেন তিনি ভাবিলেন না—বর্তমান বঙ্গাধিপকে দেশের লোক যথার্থ রক্ষক‌ বলিয়া অনুভব করিয়াছে, তাঁহারই সহৃদয়তা দেশের হৃদয়কে ইংরাজের দিকে আকর্ষণ করিতেছে।

কিন্তু বোধ করি যাহাদের অতিশয় বুদ্ধি, সরল মীমাংসাই তাহাদের পক্ষে সর্বাপেক্ষা দুর্গম। একটা কোথাও কিছু গোল আছে এটা বোধ করি বুদ্ধিমানের কথা। কারণ, গোল যদি দৈবাৎ বাহির হইয়া পড়ে তবে বুদ্ধিমান তাঁহার বুদ্ধির জয়ঢাক বাজাইতে পারিবেন, যদি বাহির না'ই হয় সেটা যে কোনো-একটা জায়গায় নাই তাহার অপ্রমাণ করিবে কে!

আরো একটা কথা আছে। নিজেদের যে লেশমাত্র দোষ নাই এ কথা মনে করিতে আরাম আছে— এবং ইংরাজ আরাম ভালোবাসে। দেশের জনসাধারণ কেনই-বা ইংরাজের প্রতি কোনো অবস্থায় কিছুমাত্র বিদ্বেষভাব বহন করিবে তাহা ইংরাজ কিছুতেই