প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
ইতিমধ্যে কলিকাতায় প্লেগ দেখা দিল। ভাবিলাম, শংকরের অপেক্ষা তাঁহার ভূতপ্রেতগুলার ভয় বেশি— এবং ভারত-গবর্মেন্টের যেরূপ মেজাজ তাহাতে প্লেগ অপেক্ষা প্লেগ-রেগ্যুলেশন বেশি রুদ্রমূর্তি ধারণ করিয়া উঠিবে। সতর্ক থাকিলে প্লেগের হস্ত অনেকে এড়াইবে, কিন্তু রেগ্যুলেশনের হস্তে কাহারও রক্ষা নাই।
এমন সময় বুড্বর্ন্-সাহেব মাভৈঃধ্বনি ঘোষণা করিলেন। বুঝিলাম, বাংলাদেশে রাজার অভ্যুদয় হইয়াছে; এখানে রেগ্যুলেশন-নামক এঞ্জিনের শাসন নহে, রাজার রাজ্য। ইহাতেই রাজভক্তি জাগিয়া উঠে। রাজার ইচ্ছা আমার ইচ্ছার সহিত একভাবে মিলিতে পারে ইহা জানিতে পারিলে রাজাকেও মনুষ্য বলিয়া প্রীতি করি এবং আপনার প্রতিও মনুষ্য বলিয়া শ্রদ্ধা জন্মে।
এ কথা কেহই অস্বীকার করিতে পারিবেন না যে, আজকাল কিপ্লিং প্রভৃতি বিখ্যাত লেখকগণের উপন্যাসে ভারতবর্ষ ও তাহার অধিবাসীবর্গ যেরূপ বর্ণে চিত্রিত হইতেছে এবং ভারতবর্ষীয় ইংরাজদের মধ্যে এ-দেশীয়দের বিরুদ্ধে ক্রমশই যে-একটা সাম্প্রদায়িক সংস্কার বদ্ধমূল হইয়া যাইতেছে এবং যাহার অবশ্যম্ভাবী প্রতিঘাতস্বরূপে উত্তরোত্তর ভারতবাসীর মনে ইংরাজ ও সর্বপ্রকার ইংরাজি প্রভাবের প্রতিকূলে যে-একটা পরাঙ্মুখভাব বৃদ্ধি পাইতেছে, অল্পে অল্পে তাহার প্রতিকার-সাধন করিতে পারেন পশ্চিমের ম্যাকডোনেল, এবং আশা করি আমাদের বুড্বর্ন্-সাহেবের ন্যায় ক্ষমা-ধৈর্য-পরায়ণ সহৃদয় শাসনকর্তৃগণ। কঠিন আইন ও জবর্দস্তিতে সম্পূর্ণ উলটা ফল ফলিবে, ইহা আমরা জোর করিয়া বলিতে পারি।
এখন এমন-একটা অবস্থা দাঁড়াইয়াছে যে, ইংরাজ এবং দেশী উভয়েই পরস্পর পরস্পরকে ভুল বুঝিবার, অন্যায় বিচার করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে।
কিন্তু ক্ষমতা যাহার হস্তে বিচারের শেষ ফল সেই দিতে পারে। আমাদের মন বিগড়াইয়া গেলে আমরা কাগজে দু-চার কথা বলিতে পারি, কিন্তু কর্তৃপক্ষের মন বিগড়াইয়া গেলে তাঁহারা আমাদের কাগজের গলা চাপিয়া ধরিতে পারেন। আমরা ক্ষুব্ধ হইলে তাহা রাজবিদ্রোহ। কিন্তু রাজারা রুখিয়া থাকিলে তাহা কি প্রজাবিদ্রোহ নহে। উভয়েরই ফল কি রাজ্যের পক্ষে সমান অমঙ্গলজনক নহে।
কিন্তু দুই দিক বিচার করা কাজটা কঠিন, বিশেষত দুই দিকের মধ্যে এক দিক যখন নিজের দিক। তথাপি নীতিতত্ত্ববিৎমাত্রেই বলিয়া থাকেন, পরের অপেক্ষা নিজেকে কঠিন বিচারাধীনে আনিলে নিজের পক্ষেই মঙ্গল। ঈসপের কথামালায় আছে— কানা হরিণ পরপারের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া ঘাস খাইত, তাহার নিজ পারের দিক হইতেই ব্যাধের শর তাহাকে বিদ্ধ করিয়াছিল। নিজের দিকে সকলে কানা, এইজন্য সর্বাপেক্ষা গুরুতর অকল্যাণ সেই দিকেই প্রবল হইয়া উঠে।
আমাদেরও সেই দশা, ইংরাজেরও তাই। যাহা সর্বাগ্রে আমাদের নিজের কর্তব্য তাহার প্রতি আমরা উদাসীন এবং গবর্মেন্টের কর্তব্যের প্রতি আমাদের শত চক্ষু এবং সহস্র জিহ্বা। ইংরাজেরও প্রজার সামান্যমাত্র চাঞ্চল্যের প্রতি রুদ্র রূপ, কিন্তু নিজে যে প্রতিদিন ঔদ্ধত্য ও অবমাননার দ্বারা প্রজাসাধারণকে নানা আকারে ক্ষুব্ধ করিয়া তুলিতেছেন তাহার বিষময়তার প্রতি কর্তৃপক্ষের শৈথিল্য থাকাতে তাহা প্রশ্রয় পাইয়া বিরাটমূর্তি ধারণ করিতেছে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমরা একটা উদাহরণ দিতেছি। অনিচ্ছার কারণ এই, বারংবার নিজেদের এই-সকল হীনতার দৃষ্টান্ত আলোচনা করিতে সংকোচ বোধ হয়। মাঝে মাঝে প্রায়ই শুনা যায়, গোরা সৈন্য শিকার-উপলক্ষে এ-দেশী গ্রামবাসীর হত্যার কারণ হইয়া পড়ে। মান্দ্রাজে ঘণ্টাকুলের হত্যা ব্যাপারে দেশীয় দ্বাররক্ষীর মহত্ত্ববিবরণ এমন জড়িত রহিয়াছে যে, তাহা বিস্মৃত হওয়া ভারতবাসীর পক্ষে সুকঠিন।
দেশীয় লোককে হত্যা করিয়া এ-পর্যন্ত বাংলাদেশে কেবল বহুকাল পূর্বে একজন ইংরাজের ফাঁসি হইয়াছিল। অভিযুক্তগণ