পরিশিষ্ট

এ দিকে ইংলন্ডে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের দলও দিনে দিনে বাড়িয়া উঠিতেছে। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের সাহিত্যও বিস্তারলাভ করিতেছে। ইংলন্ডের ভূমিতে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের মত ক্রমশ বদ্ধমূল হইয়া শাখাপল্লবিত হইতেছে। এই স্থলে ন্যায়ানুরোধে এ কথাও বলিয়া রাখা উচিত, অনেক অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ভারতকার্য হইতে অবসর লইয়া স্বদেশে ফিরিয়া নিঃসহায় ভারতবাসীদের প্রতি পরম হিতৈষিতাচরণ করিতেছেন।

এই-সকল কারণে স্বদেশস্থ ইংরাজের মধ্যেও একদল সন্দেহ করিতেছেন যে, তাঁহারা নিজেদের সম্বন্ধে যে-সকল কর্তব্য পালন করিয়া চলেন তাহার অধিকাংশই প্রাচ্যদেশীয় ভিন্নজাতীয় জীবসকলের প্রতি প্রয়োগ করিতে গেলে কুইক্সটোচিত বাতুলতার পরিচয় দেওয়া হয় কি না, তাহাতে দ্বীপবাসী সভ্যজাতির বোধশক্তির সংকীর্ণতা এবং অনভিজ্ঞতা প্রকাশ পায় কি না এবং সম্ভবত তাহাতে ভিন্নজাতীয় জীবের অনিষ্ট হয় কি না। হার্বার্ট্ স্পেন্সর প্রভৃতি ইংরাজ দার্শনিকের মত এই যে, সভ্যতার তারতম্য অনুসারে নৈতিক আদর্শের তারতম্য কেবল যে অবশ্যম্ভাবী তাহা নহে, অভিব্যক্তির নিয়মে তাহা আবশ্যক।

এই-সকল মতের সত্যাসত্য অন্য সময় বিচার হইবে; আপাতত এইটুকু বলিতে পারি, ইহার ফল আমাদের পক্ষে বড়ো পীড়াজনক। বেহারপ্রদেশে গাছে ছাপ হইতে বিদ্রোহের আশঙ্কা করিয়া অনেক ইংরাজি কাগজে এমন কথা বলা হইয়াছে যে, প্রাচ্য ও প্রতীচ্য জাতির মধ্যে কোনোকালেই যথার্থ প্রেমের সম্মিলন সম্ভব নহে। উহাদিগকে কেবলমাত্র গায়ের জোরে ভয় দেখাইয়া বশে রাখিতে হইবে। এ-সকল কথা পূর্বাপেক্ষা আজকাল যেন অধিকতর মুক্তকন্ঠে বলা হইতেছে।

আমাদের বক্তব্য এই, যদি-বা স্বীকার করা যায় যে স্বাধীনতাপ্রিয় য়ুরোপের কর্তব্যনীতি চিরপরাধীন প্রাচ্যদেশে সর্বথা উপযোগী নহে, তথাপি যখন আমাদের রাজা য়ুরোপীয় তখন প্রাচ্যদেশের স্বাভাবিক গতিকে অব্যাহত রাখিবার চেষ্টা করা তাঁহাদের পক্ষে দুরাশা মাত্র। আমাদের দেশ যদি স্বাধীন হইত তবে এই প্রাচ্যদেশে স্বাভাবিক নিয়মে যে রাজ্যতন্ত্র উদ্‌ভাবিত হইয়া উঠিত তাহা বর্তমান ইংরাজ-রাজতন্ত্র হইতে নিশ্চয়ই অনেক বিষয়ে ভিন্ন প্রকারের হইত। হয়তো এক দিক হইতে দেখিতে গেলে রাজার যথেচ্ছ প্রতাপ এখনকার অপেক্ষা অধিক মনে হইত, তেমনি আবার অন্য দিকে রাজার প্রতাপ খর্ব করিয়া প্রজাদের ইচ্ছাচালনার পথ ভিন্ন আকারে নানা উপায়ে প্রকাশ পাইত। স্বাভাবিক সামঞ্জস্য কেবল স্বাভাবিক নিয়মেই সর্বাঙ্গসম্পূর্ণরূপে অভিব্যক্ত হইয়া উঠে। ইংরাজ হাজার ইচ্ছা করিলেও কেবল পলিসির দ্বারা তাহা ঘটাইতে পারে না।

অতএব ইংরাজ আমাদের সহিত কেবল ইংরাজের মতোই ব্যবহার করিতে পারেন; যদি ইচ্ছাপূর্বক তাহা বিকৃত করেন তবে সে কেবল দুর্ব্যবহার হইবে, কোনোকালেই ভারতবর্ষীয় ব্যবহারে পরিণত হইতে পারিবে না। তাঁহাদের নিজের আদর্শ তাঁহারা ভাঙিতে পারেন, কিন্তু তাহার স্থলে গড়িবেন কী এবং গড়িবেন কী করিয়া। মাঝে হইতে চিরাভ্যস্ত স্বদেশী আদর্শ -চ্যুত ইংরাজ আমাদের পক্ষে বড়ো-একটি ভয়ংকর প্রাণী হইয়া দাঁড়াইবার সম্ভাবনা। রাড্‌ইয়ার্ড্ কিপ্‌লিং প্রভৃতি লেখকের লেখার মধ্যে যে-একটি বলদর্প-মিশ্রিত নিষ্ঠুরতার আভাস অনুভব করা যায় তাহা হইতে মনে হয়, মানব মধ্যে মধ্যে সভ্যতার শততন্তুনির্মিত সূক্ষ্ম সুদৃঢ় জাল ছিন্ন করিয়া ফেলিয়া আদিম আরণ্য প্রকৃতির বর্বরতার মধ্যে ঝাঁপ দিয়া পড়িতে ইচ্ছা করে। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানগণ ভারতবর্ষে আসিয়া যে-এক সুতীব্র ক্ষমতা-মদিরার আস্বাদন পায় তাহাতেই এই প্রচণ্ড মত্ততার সৃষ্টি করিতে পারে। এই প্রেমহীন কঠিন ক্ষমতাদম্ভ প্রতিভাসম্পন্ন পূরুষের লেখনীতে অকৃত্রিম অসংকোচ পৌরুষ-আকারে একপ্রকার ভীষণ রমণীয়তা ধারণ করে; তাহা ইংরাজের পক্ষে সাহিত্য, কিন্তু আমাদের পক্ষে মৃত্যুর নিদান!

দ্বিতীয় কথা এই, আজকালকার উপন্যাসে লেখকেরা প্রাচ্য প্রকৃতিকে পাশ্চাত্য দেশের নিকট যতটা রহস্যময় বলিয়া বর্ণনা করেন তাহার অনেকটা কাল্পনিক। আমাদের পরস্পরের মধ্যে সহস্র যোগ আছে। অন্তরের সাদৃশ্য অনেক সময় বাহ্য বৈসাদৃশ্যে আচ্ছন্ন হইয়া থাকে মাত্র। আধুনিক লেখকগণ সেই বাহ্য বৈসাদৃশ্যগুলির নূতনত্বকে পাঠকদের মনোরঞ্জনার্থে রঞ্জিত অতিরঞ্জিত করিয়া তুলিতে থাকেন এবং সুগভীর সাদৃশ্যগুলি উদ্ধার করিবার চেষ্টাও পান না ক্ষমতাও রাখেন না।