পরিশিষ্ট

তবে বাহির হইতে একটা উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। গাজিপুরের জজ ফক্‌স্‌-সাহেব ন্যায়পরায়ণ বলিয়া সাধারণের নিকট সুবিদিত। গোহত্যাসম্বন্ধীয় মকদ্দমার আপীল হাইকোর্ট তাঁহার নিকট হইতে তুলিয়া লইয়াছে।

ফক্‌স্‌-সাহেব হিন্দু নহেন; গোজাতির এবং গোবৎসল জাতির প্রতি তাঁহার বিশেষ পক্ষপাত থাকিবার কোনো কারণ দেখা যায় না। গোসম্প্রদায়ের প্রতি যদি তাঁহার কোনো পক্ষপাত থাকে সেও কেবল খাদকভাবে।

দ্বিতীয়ত, এই গোহত্যাসম্বন্ধীয় দাঙ্গাহাঙ্গামার প্রতি গবর্মেন্টের তীব্র দৃষ্টি রহিয়াছে, এবং অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানগণও বিশেষ ত্রস্ত হইয়া উঠিয়াছেন— এমন-কি, বিলাতের স্পেক্টেটর পত্রও এইরূপ উপদ্রবগুলিকে সতেজে দমন, সবলে দলন করিয়া ফেলিতে পরামর্শ দিয়াছেন। এরূপ স্থলে অন্যান্য সাধারণ মকদ্দমার অপেক্ষা এরূপ মকদ্দমা ইংরাজ বিচারক বিশেষ সতর্কভাবেই বিচার করিয়া থাকেন।

এমন অবস্থাতেও যদি গবর্মেন্ট্ ফক্‌স্‌-সাহেবের বিচারে সন্তুষ্ট না হন তবে তো তাঁহার হাতে সামান্য শসা-চুরির মকদ্দমাও রাখা উচিত হয় না।

এই-সকল লক্ষণ দেখিয়াই মনে হইতেছে, গবর্মেন্ট্ কিছু বেশি ভীত হইয়া পড়িয়াছেন। তাঁহারা ভয় পাইলেই আমাদের সর্বনাশ।

কিন্তু ভয় করিতে আরম্ভ করিলে কোথাও নিশ্চিন্ত হইবার জো নাই। ভারতবর্ষকে শিক্ষা দিয়াও ভয় হয়, আবার মূর্খ করিয়া রাখিলেও ভয় আছে।

ইংরাজি শিখিয়া আমরা আত্মদুঃখ নিবেদন করিতে শিখি, এবং সাধারণ অভাব-মোচনের উপলক্ষে সাধারণের মধ্যে ঐক্যবন্ধনের সূত্রপাত হয়। আবার যেখানে ইংরাজি শিক্ষা নাই সেখানে যে কোন্ অন্ধসংস্কারের কৃষ্ণবর্ণ বারুদে কোন্‌খান হইতে কণামাত্র অগ্নিস্ফুলিঙ্গ লাগিয়া অকস্মাৎ একটা প্রলয় দিগ্‌দাহ উপস্থিত করে তাহা বলা যায় না।

কিন্তু গবর্মেন্টের ভয়টা দেখিতে ভালো নহে। কড়া শাসন অর্থাৎ যখন বিচার-প্রণালীর মধ্যে ন্যায় অপেক্ষা বলের প্রয়োগ বেশি দেখা যায়, এবং যখন চতুর্দিক হইতে খোঁচাখুঁচি লাগাইয়া তাড়াতাড়ি দেশের লোককে ভয় পাওয়াইয়া দিবার চেষ্টা দেখিতে পাই, তখনই বুঝিতে পারি গবর্মেন্টের হৃৎস্পন্দন কিছু অযথা বাড়িয়া উঠিয়াছে। সেরূপ উগ্রতায় গবর্মেন্টের বলিষ্ঠতা প্রকাশ পায় না, কেবল ভয় প্রকাশ হয় মাত্র।

মণিপুরেই গবর্মেন্টের নিজবুদ্ধিদোষে বিভ্রাট ঘটুক আর ভারতের অন্যত্রই হিন্দুমুসলমানের অন্ধ-আক্রোশ-বশত ভ্রাতৃবিরোধের সূ্ত্রপাত হউক, গবর্মেন্টের সর্বদা মনে রাখা উচিত, শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা এবং অবিচলিত অপক্ষপাত এবং প্রশান্ত ন্যায়পরতা।

কিন্তু গবর্মেন্ট বলিতে যে কাহাকে বুঝায় আমরা কিছুই বুঝিতে পারি না। এই হিন্দুমুসলমান বিপ্লবে বড়োকর্তা ল্যান্স্‌ডাউন, মেজোকর্তা ক্রস্‌থোয়েট, এবং জেলার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছোটোকর্তাগুলি সকলেই এক পলিসি অবলম্বন করিয়া একভাবে কাজ করিতেছেন কি না জানি না। সার ওয়েডার্‌বর্ন্‌ লিখিয়াছেন, এই-সমস্ত উপদ্রবে গবর্মেন্টের কিছু হাত আছে; ল্যান্স্‌ডাউন বলেন, এমন কথা যে বলে সে অত্যন্ত দুষ্ট। আমরা ইহার একটা সামঞ্জস্য করিয়া লই।

আমরা বলি, গবর্মেন্টের পলিসি যেমনই থাক্, ইংরাজ কর্মচারীগণ গবর্মেণ্টের যন্ত্র নহে, তাহারা মানুষ। আপন অধিকারের মধ্যে তাহাদের বিরাগ অনুরাগ মতামত খাটাইবার যথেষ্ট অবসর আছে। কন্‌গ্রেস এবং শিক্ষিত বাবুদের আচরণে তাহাদের যদি এমন ধারণা হয় যে, হিন্দুমুসলমানদিগকে পৃথক করিয়া রাখা আবশ্যক, তবে তাহারা ছোটোবড়ো এত উপায় অবলম্বন করিয়া বিদ্বেষবীজ বপন করিতে পারে যে, গবর্মেন্টের পরম উদার সদভিসন্ধি তাহার নিকট হার মানে।

গবর্মেন্টের আইন কাহাকেও ঘৃণা করে না, ভয় করে না; পক্ষপাত করে না। কিন্তু ইংরাজ করে। পায়োনিয়র ইংলিশ্‌ম্যান