প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
গ্রিফিন বাঙালিকে রাজনৈতিক অধিকার হইতে বঞ্চিত করিবার পূর্বে নিজেদের পার্লামেন্টে একটা নূতন নিয়ম প্রচার করিবার চেষ্টা করিবেন। এবার হইতে বক্তৃতামঞ্চে বাগ্যুদ্ধে পার্লামেন্টের মেম্বর নির্বাচিত না হইয়া মল্লভূমে দ্বন্দ্বযুদ্ধে সভ্য স্থির হইবে। তাহা হইলে ইংরাজ মন্ত্রী-সভায় কেবল বীরমন্ডলীই অধিকার লাভ করিবে এবং যাহারা শুদ্ধমাত্র কলম চালাইতে জানে তাহারা ফর্ট্নাইট্লি রিভিয়ুতে অত্যন্ত ঝগড়াটে সুরে প্রবন্ধ লিখিবে।
১৮৫৫ খৃস্টাব্দে হিন্দু মহাজনদের দ্বারা একান্ত উৎপীড়িত হইয়া গবর্মেন্টের নিকট নালিশ করিবার জন্য সাঁত্ততালগণ তাহাদের অরণ্য-আবাস ছাড়িয়া কলিকাতা-অভিমুখে যাত্রা করিয়াছিল। তখন ইংরাজ সাঁত্ততালকে ভালো করিয়া চিনিত না। তাহারা কী চায়, কেন বাহির হইয়াছে, কিছুই বুঝিতে পারিল না। এ দিকে পথের মধ্যে পুলিস তাহাদের সহিত লাগিল, আহারও ফুরাইয়া গেল— পেটের জ্বালায় লুটপাট আরম্ভ হইল। অবশেষে গবর্মেন্টের ফৌজ আসিয়া তাহাদিগকে দলকে-দল গুলি করিয়া ভূমিসাৎ করিতে লাগিল।
এই ঘটনার উপলক্ষে হান্টার-সাহেব বলেন, ভারতবর্ষে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান-সম্প্রদায়ের সংখ্যা অল্প এবং তাহারা বহুসংখ্যক ভিন্নজাতীয় অধিবাসীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। এরূপ অবস্থায় সামান্য সূত্রপাতেই বিপদের আশঙ্কাটা অত্যন্ত প্রবল হইয়া উঠে। তখন পরিণামের প্রতি লক্ষ করিয়া ধীরভাবে বিবেচনা করিবার সময় থাকে না— অতিসত্বর সবলে একটা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করিয়া ফেলিবার প্রবৃত্তি জন্মে। যখন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানগণ এইরূপ কোনো কারণে অকস্মাৎ সন্ত্রস্ত হইয়া উঠে তখনই গবর্মেন্টের মাথা ঠান্ডা রাখা বিশেষরূপে আবশ্যক হয়। হান্টার বলেন, এরূপ উত্তেজনার সময় ভারত-গবর্মেণ্ট্কে প্রায়ই ঠাণ্ডা থাকিতে দেখা গিয়াছে।
উপরি-উক্ত সাঁত্ততাল-উপপ্লবে কাটাকুটির কার্যটা বেশ রীতিমত সমাধা করিয়া এবং বীরভূমের রাঙা মাটি সাঁত্ততালের রক্তে লোহিততর করিয়া দিয়া তাহার পরে ইংরাজ-রাজ হতভাগ্য বন্যদিগের দুঃখনিবেদনে কর্ণপাত করিলেন। যখন বন্দুকের আওয়াজটা বন্ধ করিয়া তাহাদের সকল কথা ভালো করিয়া শুনিলেন তখন বুঝিলেন তাহাদের প্রার্থনা অন্যায় নহে। তখন তাহাদের আবশ্যকমত আইনের সংশোধন, পুলিসের পরিবর্তন এবং যথোপযুক্ত বিচারশালার প্রতিষ্ঠা করা হইল।
কিন্তু অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান-সম্প্রদায়ের উষ্মা তখনো নিবারণ হইল না। বিদ্রোহীদের প্রতি নিরতিশয় নির্দয় শাস্তিবিধান না করিয়া তাহারা ক্ষান্ত হইতে চাহে না। তাহারা বলিল, বিদ্রোহীরা যাহা চাহিয়াছিল সকলই যদি পাইল তবে তো তাহাদের বিদ্রোহের সার্থকতাসাধন করিয়া একপ্রকার পোষকতা করাই হইল। ক্যাল্কাটা রিভিয়ু পত্রের কোনো ইংরাজ লেখক এই শান্তিপ্রিয় নিরীহ সাঁত্ততালদিগকে বনের ব্যাঘ্র, রক্তপিপাসু বর্বর প্রভৃতি বিশেষণে অভিহিত করিয়া এক প্রবন্ধ লিখিলেন। তাহাতে কেবল দোষীদিগকে নহে, বিদ্রোহী জেলার অধিবাসীবর্গকে একেবারে সর্ব-সমেত সমুদ্রপারে দ্বীপান্তরিত করিয়া দিবার জন্য গবর্মেন্ট্কে অনুরোধ করিলেন।
মনে একবার ভয় ঢুকিলে বিচারও থাকে না, দয়াও থাকে না। আমাদের সংস্কৃতশাস্ত্রে আছে— শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা। কেবল ভূষণ কেন, তাহা স্বাভাবিক বলিলেও নিতান্ত অত্যুক্তি হয় না। যেখানে মনে মনে আত্মশক্তির অভাব -আশঙ্কা হয় সেখানে মানুষ হয় অগত্যা ক্ষমা করে, নয় লেশমাত্র ক্ষমা করে না— নিষ্ঠুরভাবে অন্যকে ভয় দেখাইতে চেষ্টা করে। অনেক সময় হিংস্র পশু যে অগ্রসর হইয়া আক্রমণ করে, সকলেই জানেন, ভয়ই তাহার মূল কারণ, হিংস্রতা নহে।
ইংরাজ যখন কোনো কারণে আমাদিগকে ভয় করে তখনই সেটা আমাদের পক্ষে বড়ো ভয়ের বিষয় হইয়া দাঁড়ায়— তখনই