বাঙালি কবি নয় কেন?

ভাসিল; লভিতে যেন প্রিয় রবি

আলিঙ্গন, ভ্রমি’ অলক্ষেতে শশি

অর্ধ সৌর রাজ্য বিরহেতে কৃশ,

নিরাশা মলিন।”

যখন তুমি বল, আমি অমুক স্থানে একটি মানুষকে দেখিলাম, তখন জানিলাম, তুমি খুব অল্পই দেখিয়াছ; যখন বল যে, হরিহরকে দেখিয়াছ, তখন জানিলাম, যে, হাঁ, একটু ভালো করিয়া দেখিয়াছ; আর যখন বল যে, হরিহরকে দেখিলাম তাহার চোখে ও অধরে ক্রোধ, ও সমস্ত মুখে একটি গুপ্ত সংকল্প প্রকাশ পাইতেছে, তখন বুঝিলাম যে, একটি মানুষকে যতদূর দেখিবার তাহা দেখিয়াছ। আমরা কবিতার যেরূপ স্বভাব বর্ণনা করি, তাহাতে প্রকাশ পায় যে, আমরা সেই মানুষটিকে মাত্র দেখিয়াছি, হরিহরকে দেখি নাই। যদি বা হরিহরকে দেখিয়া থাকি, অর্থাৎ সেই মানুষটির নাক কান চোখ মুখ বিশেষরূপে দেখিয়া থাকি, তথাপি তাহার নাক কান চোখ মুখের মধ্যে আর কিছু দেখিতে পাই নাই। যখন আমরা একটি মানুষের ঠোঁটে, চোখে ও সমস্ত মুখে একটা কিছু বিশেষ ভাব দেখিতে পাই তখন আমরা কেবলমাত্র সেই মানুষকে জীবন্ত বলিয়া দেখি না; তখন তাহার ঠোঁট ও চোখকে আমরা জীবন্ত করিয়া দেখি। তখন আমরা তাহার ঠোঁটের ও চোখের একটি হৃদয়, একটি প্রাণ দেখিতে পাই। এই হৃদয়, এই প্রাণ দেখিতে পাওয়া দেখিতে পাওয়ার চূড়ান্ত ফল। বাংলা কবিতার স্বভাব বর্ণনায় প্রকৃতির এই হৃদয়, এই প্রাণ দেখিতে পাই না।

“সরোবরে সরোরুহ, কুমুদ কহ্লার সহ

শরতে সুন্দর হোয়ে শোভা দিয়ে ফুটেছে।”

ইহা লক্ষ্য করিয়া দেখিতে একরূপ চক্ষুর আবশ্যক, আর-

“Then the pied wind flowers and the tulip tall,

And narcissi, the fairest among them all,

Who gaze on their eyes in the stream’s recess

Till they die of their own dear loveliness

And the rose, like a nymph to the bath addressed.

Which unveiled the depth of her glowing breast,

Till, fold after fold, to the fainting air

The soul of her beauty and love lay bare.”

ইহ দেখিতে স্বতন্ত্র চক্ষুর আবশ্যক করে। একটি শতক্ষদভড়ড়য়ড় ফুল, যে স্রোতের পার্শ্বে ফুটিয়া দিন রাত্রি জলের মধ্যে নিজের মুখখানি, নিজের সৌন্দর্য দেখিতে দেখিতে শুকাইয়া মরিয়া যায়, তাহার সে একটি মিষ্ট ভাব, অথবা একটি বিকাশোন্মুখ গোলাপের পাপড়িগুলি যখন একটি একটি করিয়া খুলিতে থাকে অবশেষে তাহার অতুল রূপ একেবারে অনাবৃত হইয়া পড়ে তখন তাহার সেই লাজুক সৌন্দর্য কয়জন লোক দেখিতে পায়? কিন্তু-

“মরাল আনন্দ মনে ছুটিল কমল বনে,

চঞ্চল মৃণাল দল ধীরে ধীরে দুলিল;

বক হংস জলচর ধৌত করি কলেবর

কেলি হেতু কলরবে জলাশয়ে নামিল।”