মেঘনাদবধ কাব্য

কুলগ্নে করিলা যাত্রা মদন; কুলগ্নে

করি যাত্রা গেলা চলি মেঘনাদ বলী–

বিলাপিলা যথা রতি প্রমীলা যুবতী। ইত্যাদি

বলপূর্বক ইন্দ্রজিৎকে মদন ও প্রমীলাকে রতি করিতেই হইবে। রতির ন্যায় প্রমীলাকে ছাড়িয়া মদনের ন্যায় ইন্দ্রজিৎ চলিলেন, মদন কুলগ্নে যাত্রা করিয়াছিলেন, ইন্দ্রজিৎও তাহাই করিলেন। তখন মদন ও ইন্দ্রজিৎ একই মিলিয়া গেল, আর রতিও কাঁদিয়াছিলেন, রতিরূপিনী প্রমীলাও কাঁদিলেন, তবে তো রতি আর প্রমীলার কিছুমাত্র ভিন্নতা রহিল না।

আবার আর-একটি কৃত্রিমতাময় রোদন আসিয়াছে, যখন ইন্দ্রজিৎ গজেন্দ্রগমনে যুদ্ধে যাইতেছেন তখন প্রমীলা তাঁহাকে দেখিতেছেন আর কহিতেছেন-

জানি আমি কেন তুই গহন কাননে

ভ্রমিস্‌রে গজরাজ! দেখিয়া ও গতি-

কী লজ্জায় আর তুই মুখ দেখাইবি,

ভিমানী? সরু মাজা তোর রে কে বলে,

রাক্ষস-কুল-হর্য্যক্ষে হেরে যার আঁখি,

কেশরি? তুইও তেঁই সদা বনবাসী।

নাশিস্‌ বারণে তুই, এ বীর-কেশরী

ভীম প্রহরণে রণে বিমুখে বাসরে,           ইত্যাদি

এই কি হৃদয়ের ভাষা? হৃদয়ের অশ্রুজল? হেমবাবু কহিয়াছেন ‘বিদ্যাসুন্দর এবং অন্নদামঙ্গল ভারতচন্দ্র-রচিত সর্বোৎকৃষ্ট কাব্য, কিন্তু যাহাতে অন্তর্দাহ হয়, হৃৎকম্প হয়, তাদৃশ ভাব তাহাতে কই? ’ সত্য, ভারতচন্দ্রের ভাষা কৌশলময়, ভাবময় নহে, কিন্তু ‘জানি আমি কেন তুই’ ইত্যাদি পড়িয়া আমরা ভারতচন্দ্রকে মাইকেলের নিমিত্ত সিংহাসনচ্যুত করিতে পারি না। তাহার পরে প্রমীলা যে ভগবতীর কাছে প্রার্থনা করিয়াছেন তাহা সুন্দর হইয়াছে। ইন্দ্রজিতের মৃত্যুবর্ণনা, লক্ষ্মণের চরিত্র-সমালোচনাস্থলে আলোচিত হইবে।

মেঘনাদবধ কাব্যের মধ্যে এই ইন্দ্রজিতের চরিত্রই সর্বাপেক্ষা সুচিত্রিত হইয়াছে। তাহাতে একাধারে কোমলতা বীরত্ব উভয় মিশ্রিত হইয়াছে।

ইন্দ্রজিতের যুদ্ধযাত্রার সময় আমরা প্রথমে প্রমীলার দেখা পাই, কিন্তু তখন আমরা তাঁহাকে চিনিতে পারি নাই, তৃতীয় সর্গে আমরা প্রমীলার সহিত বিশেষরূপে পরিচিত হই। প্রমীলা পতিবিরহে রোদন করিতেছেন।

উতরিলা নিশাদেবী প্রমোদ উদ্যানে।

শিহরি প্রমীলা সতী, মৃদু কলস্বরে,

বাসন্তী নামেতে সখি বসন্ত সৌরভা,

তার গলা ধরি কাঁদি কহিতে লাগিলা;

‘ওই দেখো আইল লো তিমির যামিনী,

কাল ভুজঙ্গিনীরূপে দংশিতে আমারে,

বাসন্তি! কোথায় সখি, রক্ষঃ কুলপতি,

অরিন্দম ইন্দ্রজিৎ, এ বিপত্তি কালে?’        ইত্যাদি।