মেঘনাদবধ কাব্য

যে কৈলাস-শিখরী চূড়ায় বসিয়া মহাদেব ধ্যান করিতেছেন কোথায় তাহা উচ্চ হইতেও উচ্চ হইবে, কোথায় তাহার বর্ণনা শুনিলে আমাদের গাত্র রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিবে, নেত্র বিস্ফারিত হইবে, না ‘শিখি-পুচ্ছ চূড়া যথা মাধবের শিরে!’ মাইকেল ভালো এক মাধব শিখিয়াছেন, এক শিখিপুচ্ছ, পীতধরা, বংশীধ্বনি আর রাধাকৃষ্ণ কাব্যময় ছড়াইয়াছেন। কৈলাস-শিখরের ইহা অপেক্ষা আর নীচ বর্ণনা হইতে পারে না। কোনো কবি ইহা অপেক্ষা কৈলাস-শিখরের নীচ বর্ণনা করিতে পারেন না।

শরদিন্দু পুত্র, বধূ শারদ কৌমুদী;

তারা কিরীটিনী নিশি সদৃশী আপনি

রাক্ষস-কুল-ঈশ্বরী! অশ্রুবারিধারা

শিশির, কপোল পর্ণে পড়িয়া শোভিল।

এই-সকল টানিয়া বুনিয়া বর্ণনা আমাদের কর্ণে অসম-ভূমি-পথে বাধা-প্রাপ্ত রথচক্রের ঘর্ঘর শব্দের ন্যায় কর্কশ লাগে।

গজরাজ তেজঃ ভুজে; অশ্বগতি পদে;

স্বর্ণরথ শিরঃ চূড়া; অঞ্চল পতাকা

রত্নময়; ভেরী, তূরী, দুন্দুভি, দামামা

আদি বাক্য সিংহনাদ! শেল, শক্তি, জাটি,

তোমর, ভোমর, শূল, মুষল, মুদগর,

পট্টিশ, নারাচ, কৌন্ত–শোভে দন্তরূপে!

জনমিলা নয়নাগ্নি সাঁজোয়ার তেজে।

পাঠকেরা বলুন দেখি এরূপ বর্ণনা সময়ে সময়ে হাস্যজনক হইয়া পড়ে কি না!

যখন মেঘনাদ রথে উঠিতেছেন তখন প্রমীলা আসিয়া কাঁদিয়া কহিলেন,

কোথায় প্রাণ সখে,

রাখি এ দাসীরে, কহো, চলিলা আপনি?

কেমনে ধরিবে প্রাণ তোমার বিরহে

এ অভাগী? হায়, নাথ, গহন কাননে,

ব্রততী বাঁধিলে সাধে করি-পদ, যদি

তার রঙ্গরসে মনঃ না দিয়া মাতঙ্গ

যায় চলি, তবু তারে রাখে পদাশ্রমে

যূথনাথ। তবে কেন তুমি, গুণনিধি

ত্যজ কিঙ্করীরে আজি?

হৃদয় হইতে যে ভাব সহজে উৎসারিত উৎস-ধারার ন্যায় উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে তাহার মধ্যে কৃত্রিমতা বাক্যেকৌশল প্রভৃতি থাকে না। প্রমীলার এই ‘রঙ্গরসের’ কথার মধ্যে গুণপনা আছে, বাক্যচাতুরীও আছে বটে, কিন্তু হৃদয়ের উচ্ছ্বাস নাই।

ইহার সহিত একটি স্বভাব-কবি-রচিত সহজ হৃদয়ভাবের কবিতার তুলনা করিয়া দেখো, যখন অক্রূর কৃষ্ণকে রথে লইতেছেন, তখন রাধা বলিতেছেন,

রাধারে চরণে ত্যজিলে রাধানাথ,