বসন্তরায়

কুসুমশয়ানে           মিলিত নয়ানে

উলসিত অরবিন্দ,

শ্যামসোহাগিনী           কোরে ঘুমায়লি

চাঁদের উপরে চন্দ।

কুঞ্জ কুসুমিত           সুধাকরে রঞ্জিত

তাহে পিককুল গান –

মরমে মদনবাণ           দুঁহে অগেয়ান,

কি বিধি কৈল নিরমাণ।

মন্দ মলয়জ           পবন বহে মৃদু

ও সুখ কো করু অন্ত।

সরবস-ধন           দোঁহার দুঁহু জন,

কহয়ে রায় বসন্ত।

মৃদু বাতাস বহিতেছে, কুঞ্জে জ্যোৎস্না ফুটিয়াছে, চাঁদনী রাত্রে কোকিল ডাকিতেছে, এবং সেই কুঞ্জে, সেই বাতাসে, সেই জ্যোৎস্নায়, সেই কোকিলের কুহুরবে, কুসুমশয়ানে মুদিত নয়ানে, দুটি উলসিত অলসিত অরবিন্দের মত, শ্যামের কোলে রাধা– চাঁদের উপরে চাঁদ ঘুমাইয়া আছে। কি মধুর! কি সুন্দর! এত সৌন্দর্য্য স্তরে স্তরে একত্রে গাঁথা হইয়াছে– সৌন্দর্য্যের পাপড়ির উপরে পাপড়ি বিন্যাস হইয়াছে যে, সবসুদ্ধ লইয়া একটি সৌন্দর্য্যের ফুল, একটি সৌন্দর্য্যের শতদল ফুটিয়া উঠিয়াছে। “ও সুখ কো করু অন্ত”– এমন মিলন কোথায় হইয়া থাকে!

বসন্তরায়ের কবিতায় আর একটি মোহমন্ত্র আছে, যাহা বিদ্যাপতির কবিতায় সচরাচর দেখা যায় না! বসন্তরায় প্রায় মাঝে মাঝে বস্তুগত বর্ণনা দূর করিয়া দিয়া এক কথায় এমন একটি ভাবের আকাশ খুলিয়া দেন, যে, আমাদের কল্পনা পাখা ছড়াইয়া উড়িয়া যায়, মেঘের মধ্যে হারাইয়া যায়! এক স্থলে আছে – “রায় বসন্ত কহে ও রূপ পিরীতিময়।” রূপকে পিরীতিময় বলিলে যাহা বলা হয়, আর কিছুতে তাহার অপেক্ষা অধিক বলা যায় না। যেখানে বসন্তরায় শ্যামের রূপকে বলিতেছেন –

কমনীয়া কিশোর      কুসুম অতি সুকোমল

          কেবল রস নিরমাণ

সেখানে কবি এমন একটি ভাব আনিয়াছেন যাহা ধরা যায় না, ছোঁওয়া যায় না। সেই ধরা-ছোঁওয়া দেয় না– এমন একটি ভাবকে ধরিবার জন্য কবি যেন আকুল ব্যাকুল হইয়া পড়িয়াছেন। “কমনীয় “ “কিশোর” “সুকোমল” প্রভৃতি কত কথাই ব্যবহার করিলেন, কিছুতেই কুলাইয়া উঠিল না– অবশেষে সহসা বলিয়া ফেলিলেন “কেবল রসনিরমাণ! “ কেবল তাহা রসেই নির্মিত হইয়াছে, তাহার আর আকার প্রকার নাই।

শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে বলিতেছেন–

আলো ধনি, সুন্দরি, কি আর বলবি?

তোমা না দেখিয়া আমি কেমনে রহিব?

তোমার মিলন মোর পুণ্যপুঞ্জরাশি,

মরমে লাগিছে মধুর মৃদু হাসি!