বসন্তরায়
ইহার প্রথম দুটি ছত্রে ভাবের অধীরতা, ভাষার বাঁধ ভাঙ্গিবার জন্য ভাবের আবেগ কী চমৎকার প্রকাশ পাইতেছে! “প্রাণনাথ কেমন করিব আমি! “ ইহাতে কতখানি আকুলতা প্রকাশ পাইতেছে! আমার প্রাণ তোমাকে লইয়া কি-যে করিতে চায় কিছু বুঝিতে পারি না। এত দেখিলাম, এত পাইলাম, তবুও প্রাণ আজও বলিতেছে “প্রাণনাথ কেমন করিব আমি! “ বিদ্যাপতি বলিয়াছেন –

লাখ লাখ যুগ              হিয়ে হিয়ে রাখনু

           তবু হিয়ে জুড়ন না গেল!

বিদ্যাপতি সমস্ত কবিতাটিতে যাহা বলিয়াছেন, ইহার এক কথায় তাহার সমস্তটা বলা হইয়াছে এবং তাহা অপেক্ষা শতগুণ অধীরতা ইহাতে ব্যক্ত হইতেছে। “প্রাণনাথ কেমন করিব আমি! “ দ্বিতীয় ছত্রে রাধা শ্যামের মুখের দিকে আকুল নেত্রে চাহিয়া কহিতেছেন “কে জানে কেমন তুমি! “ যাহার এক তিল ঊর্ধ্বে উঠিলেই ভাষা মরিয়া যায়, সেই ভাষায় শেষ সীমায় দাঁড়াইয়া রাধা বলিতেছেন “কে জানে কেমন তুমি!”

আর এক স্থলে রাধা বলিতেছেন –

ওহে নাথ, কিছুই না জানি,

তোমাতে মগন মন দিবস রজনী।

জাগিতে ঘুমিতে চিতে তোমাকেই দেখি,

পরাণপুতলী তুমি জীবনের সখি!

অঙ্গ-আভরণ তুমি শ্রবণরঞ্জন,

বদনে বচন তুমি নয়নে অঞ্জন!

নিমিখে শতেক যুগ হারাই হেন বাসি,

রায় বসন্ত কহে পহু প্রেমরাশি!

ঠিক কথা বটে- নিমিখে শতেক যুগ হারাই হেন বাসি! যতই সময় পাওয়া যায়, ততই কাজ করা যায়। আমাদের হাতে “শতেক যুগ” নাই বলিয়া আমাদের অনেক কাজ অসম্পূর্ণ থাকে। শতেক যুগ পাইলে আমরা অনেক কাজ সম্পূর্ণ করিয়া যাইতে পারি। কিন্তু প্রেমের সময়গণনা যুগ যুগান্তর লইয়া নহে। প্রেম নিমিখ লইয়া বাঁচিয়া থাকে, এই নিমিত্ত প্রেমের সর্বদাই ভয়– পাছে নিমিখ হারাইয়া যায়। এক নিমিখে মাত্র আমি যে একটি চাহনি দেখিয়াছিলাম তাহাই হৃদয়ের মধ্যে লালন করিয়া আমি শতেক যুগ বাঁচিয়া থাকিতে পারি; আবার হয়তো আমি শতেক যুগ অপেক্ষা করিয়া বসিয়া আছি, কখন আমার একটি নিমেষ আসিবে, একটি মাত্র চাহনি দেখিব! দৈবাৎ সেই একটি মুহূর্ত হারাইলে আমার অতীত কালের শতেক যুগ ব্যর্থ হইল, আমার ভবিষ্যৎ কালের শতেক যুগ হয়তো নিষ্ফল হইবে। প্রতিভার স্ফূর্ত্তির ন্যায় প্রেমের স্ফূর্ত্তিও একটি মাহেন্দ্রক্ষণ একটি শুভ মুহূর্তের উপরে নির্ভর করে। হয়তো শতেক যুগ আমি তোমাকে দেখিয়া আসিতেছি, তবুও তোমাকে ভাল বাসিবার কথা আমার মনেও আসে নাই– কিন্তু দৈবাৎ একটি নিমিখ আসিল, তখন না জানি কোন্‌ গ্রহ কোন্‌ কক্ষে ছিল – দুই জনে চোখাচোখি হইল। ভালবাসিলাম। সেই এক নিমিখ হয়তো পদ্মার তীরের মত অতীত শত যুগের পাড় ভাঙিয়া দিল ও ভবিষ্যৎ শত যুগের পাড় গড়িয়া দিল। এই নিমিত্তই রাধা যখন ভাগ্যক্রমে প্রেমের শুভমুহূর্ত পাইয়াছেন তখন তাঁহার প্রতিক্ষণে ভয় হয় পাছে এক নিমিখ হারাইয়া যায়, পাছে সেই এক নিমিখ হারাইয়া গেলে শতেক যুগ হারাইয়া যায়। পাছে শতেক যুগের সমুদ্রের মধ্যে ডুবিয়া সেই নিমিখের হারানো রত্নটুকু আর খুঁজিয়া না পাওয়া য়ায। সেইজন্য তিনি বলিয়াছেন “নিমিখে শতেক যুগ হারাই হেন বাসি! “

এমন যতই উদাহরণ উদ্ধৃত হইবে ততই প্রমাণ হইবে যে, বিদ্যাপতি ও বসন্তরায় এক কবি নহেন, এমন-কি এক শ্রেণীর কবিও নহেন।