প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
তাহার নিজের সম্পত্তির উপর কতটুকুই বা অধিকার! যে নিজে খাইতে পারে, কিন্তু পরকে দিতে পারে না, সেও দরিদ্র—কিন্তু যে পরকে দিতে পারে, নিজের সম্পত্তির উপরে তাহার সর্ব্বাঙ্গীণ অধিকার জন্মিয়াছে। কারণ, ইহাই চরম অধিকার।
আমাদের পুরাণে যে বলে, যে ব্যক্তি ইহজন্মে দান করে নাই সে পরজন্মে দরিদ্র হইয়া জন্মিবে, তাহার অর্থ এইরূপ হইতে পারে যে, টাকা ত আর পরকালে সঙ্গে যাইবে না, সুতরাং টাকাগত ধনিত্ব বৈতরণীর এপার পর্য্যন্ত। যদি কিছু সঙ্গে যায় ত সে হৃদয়ের সম্পত্তি। যাহার সমস্ত টাকা কেবল নিজের জন্য—নিজের গাড়িটি ঘোড়াটির জন্যই লাগে, তাহার লাখ টাকা থাকিলেও তাহাকে দরিদ্র বলা যায় এই কারণে যে, তাহার এত সামান্য আয় যে তাহাতে কেবল তাহার নিজের পেটটাই ভরে, তাও ভরে না বুঝি! তাহার কিছুই বাকী থাকে না—যতই কিছু আসে তাহার নিজের অতি মহৎ শূন্যতা পূরাইতে, অতি বৃহৎ দুর্ভিক্ষদারিদ্র্য দূর করিতেই খরচ হইয়া যায়। সুতরাং যখন সে বিদায় হয় তখন তাহার সেই প্রকাণ্ড শূন্যতা ও হৃদয়ের দুর্ভিক্ষই তাহার সঙ্গে সঙ্গে যায়, আর কিছুই যায় না। লোকে বলে, ঢের টাকা রাখিয়া মরিল! ঠিক কথা, কিন্তু এক পয়সাও লইয়া মরিল না।
সুতরাং আত্মাকে যে দিতে পারিয়াছে আত্মা সর্বতোভাবে তাহারই। আত্মা ক্রমশই অভিব্যক্ত হইয়া উঠিতেছে। জড় হইতে মনুষ্য-আত্মার অভিব্যক্তি; মধ্যে কত কোটি কোটি বৎসরের ব্যবধান। তেমনি স্বার্থসাধনতৎপর আদিম মনুষ্য ও আত্মবিসর্জনরত মহদাশয়ের মধ্যে কত যুগের ব্যবধান। একজন নিজের আত্মাকে ভালরূপ পায় নাই, আর-একজনের আত্মা তাহার হাতে আসিয়াছে। আত্মার উপরে যাহার অধিকার জন্মে নাই, সে যে আত্মাকে রক্ষা করিতে পারিবে তাহা কেমন করিয়া বলিব? সকল মনুষ্য নহে—মনুষ্যদের মধ্যে যাঁহারা সর্বশ্রেষ্ঠ, যথার্থ হিসাবে তাঁহাদেরই আত্মা আছে। যেমন গুটিকতক ফল ফলাইবার জন্য শতসহস্র নিষ্ফল মুকুলের আবশ্যক, তেমনি গুটিকতক অমর আত্মা অভিব্যক্ত হয়, এবং লক্ষ লক্ষ মানবাত্মা নিষ্ফল হয়।
আত্মবিসর্জনের মধ্যেই আত্মার অমরতার লক্ষণ দেখা যায়। যে আত্মায় তাহা দেখা যায় না সে আত্মার যতই বর্ণ থাকুক ও যতই গন্ধ থাকুক তাহা বন্ধ্যা। একজন মানুষ কেনই বা আত্মবিসর্জন করিবে! পরের জন্য নিজেকে কেনই বা কষ্ট দিবে। ইহার কি যুক্তি আছে! যাহার সহিত নিতান্তই আমার সুখের যোগ, তাহাই আমার অবলম্ব্য আর কিছুর জন্যই আমার মাথাব্যথা নাই, এই ত ইহসংসারের শাস্ত্র। জগতের প্রত্যেক পরমাণুই আর সমস্ত উপেক্ষা করিয়া নিজে টিঁকিয়া থাকিবার জন্য প্রাণপণে যুঝিতেছে, সুতরাং স্বার্থপরতার একটা যুক্তিসঙ্গত অর্থ দেখা যাইতেছে। কিন্তু এই স্বার্থপরতার উপরে মরণের অভিশাপ দেখা যায়, কারণ ইহা সীমাবদ্ধ। ঐহিকের নিয়ম ঐহিকেই অবসান, সে নিয়ম কেবল এইখানেই খাটে। সে নিয়মে যাহারা চলে তাহারা ঐহিক অতিক্রম করিয়া আর কিছুই দেখিতে পায় না, আর কিছুর উপরেই বিশ্বাস স্থাপন করে না। কেনই বা করিবে? তাহারা দেখিতেছে এইখানেই সমস্ত হিসাব মিলিয়া যায়, অন্যত্র অনুসন্ধানের আবশ্যকই করে না। কিন্তু অমরতা কখন্ দেখিতে পায়? পৃথিবীর মাটি হইতে উদ্ভূত হইয়া পৃথিবীতেই মিলাইয়া যাইব, এ সন্দেহ কখন্ দূর হয়? যখন দেখিতে পাই, আমাদের মধ্যে এমন একটি পদার্থ আছে যে ঐহিকের সকল নিয়ম মানে না। আমরা আপনার সুখ চাই না, আমরা আনন্দের সহিত আত্মবিসর্জ্জন করিতে পারি,