প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
এই মণ্ডলীর বিস্তার লইয়া মানুষের ছোটবড়ত্ব। মনুষ্যের যে দেহ মাপিতে পারা যায় সে দেহ গড়ে প্রায় সকলেরই সমান। কিন্তু যে দেহ দেখা যায় না, মাপা যায় না, তাহার ছোট বড় সামান্য নহে। এই দেহ, এই মণ্ডলী, এই বৃহৎ দেহ, এই অবস্থাগোলক, যাহার মধ্যে আমাদের শাবক আত্মার খাদ্য সঞ্চিত ছিল, ইহাই ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া সে পরলোকে জন্মগ্রহণ করে।
যেমন মানুষের বৃহৎ দেহটি আমরা দেখিতে পাই না, তেমনি যথার্থ মানুষ যে তাহাকেও দেখিতে পাই না। এই জন্য কাহারও জীবনচরিত লেখা সম্ভব নহে। কারণ, লেখকেরা মানুষের কাজ দেখিয়া তাহার জীবনচরিত লেখেন। কিন্তু যে গোটাকতক কাজ মানুষ করিয়াছে তাই তিনি দেখিতে পান, লক্ষ লক্ষ কাজ যাহা সে করে নাই তাহা ত তিনি দেখিতে পান না। আমরা তাহার কতকগুলা কাজের টুক্রা এখান ওখান হইতে কুড়াইয়া জোড়া দিয়া একটা জীবনচরিত খাড়া করিয়া তুলি, কিন্তু তাহার সমগ্রটি ত দেখিতে পাই না। তাহার মধ্যস্থিত যে মহাপুরুষ অসংখ্য অবস্থায় অসংখ্য আকার ধারণ করিতে পারিত, তাহাকে ত দেখিতে পাই না। তাহার কাজ-কর্ম্মের মধ্যে বরঞ্চ সে ঢাকা পড়িয়া যায়; আমরা কেবলমাত্র উপস্থিতটুকু দেখিতে পাই; যত কাজ হইয়া গিয়াছে, যত কাজ হইবে, এবং যত কাজ হইতে পারিত, উপস্থিত কার্য্যখণ্ডের সহিত তাহার যোগ দেখিতে পাই না। আমরা মুহূর্তে মুহূর্তে এক-একটা কাজ দেখিয়া সেই কার্য্য-কারকের মুহূর্তে মুহূর্তে এক-একটা নাম দিই। সেই নামের প্রভাবে তাহার ব্যক্তি-বিশেষত্ব ঘুচিয়া যায়, সে একটা সাধারণ-শ্রেণী-ভুক্ত হইয়া পড়ে, সুতরাং ভিড়ের মধ্যে তাহাকে হারাইয়া ফেলি। আমরা রামকে যখন খুনী বলি, তখন সে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ খুনীর সহিত এক হইয়া যায়। কিন্তু রাম-খুনী ও শ্যাম-খুনীর মধ্যে এই খুন সম্বন্ধেই এমন আকাশ পাতাল প্রভেদ যে উভয়কে এক নাম দিলে বুঝিবার সুবিধা হওয়া দূরে থাকুক, বুঝিবার ভ্রম হয়। আমরা প্রত্যহ আমাদের কাছের লোকদিগকে এইরূপে ভুল বুঝি। তাড়াতাড়ি তাহাদের এক-একটা নামকরণ করিয়া ফেলি ও নামের কৃত্রিম খোলসটার মধ্যেই সেই ব্যক্তি ঢাকা পড়িয়া যায়। অনেক সময় মানুষ অনুপস্থিত থাকিলেই তাহাকে ঠিক জানিতে পারি। কারণ, সকল মানুষই বৃহৎ। বৃহৎ জিনিষকে দূর হইতে দেখিলেই তাহার সমস্তটা দেখা যায়, কিন্তু তাহার অত্যন্ত কাছে লিপ্ত থাকিয়া দেখিলে তাহার খানিকটা অংশ দেখা যায় মাত্র, সেই অংশকেই সমস্ত বলিয়া ভ্রম হয়। মানুষ অনুপস্থিত থাকিলে আমরা তাহার দুই চারি বর্তমান মুহূর্ত মাত্র দেখি না, যতদিন হইতে তাহাকে জানি, ততদিন সমষ্টিস্বরূপে তাহাকে জানি। সুতরাং সেই জানাটাই অপেক্ষাকৃত যথার্থ। পৃথিবীর অধিবাসীরা পৃথিবীকে কেহ বলিবে, উঁচু, কেহ বলিবে নীচু, কেহ বলিবে উঁচু-নীচু। কিন্তু যে লোক পৃথিবী হইতে আপনাকে তফাৎ করিয়া সমস্ত পৃথিবীটা কল্পনা করিয়া দেখে, সে এই সামান্য উঁচুনীচুগুলিকে গ্রাহ্য না করিয়া বলিতে পারে যে পৃথিবী সমতল গোলক। কথাটা খাঁটি সত্য নহে, কিন্তু সর্বাপেক্ষা সত্য।
আত্মার উপরে শ্রেষ্ঠ অধিকার কাহার জন্মিয়াছে? যে আত্ম-বিসর্জ্জন করিতে পারে। নাবালক যে, তাহার বিষয় আশয় সমস্তই আছে বটে, কিন্তু সে বিষয়ের উপর তাহার অধিকার নাই—কারণ, তাহার দানের অধিকার নাই। এই দানের অধিকারই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ অধিকার। যে ব্যক্তি পরকে দিতে পারে সেই ধনী। যে নিজেও খায় না পরকেও দেয় না, কেবলমাত্র জমাইতে থাকে,