একেবারেই প্রেমের যোগ্য নহে এমন জীব কোথায়! যত বড়োই পাপী অসাধু কুশ্রী সে হউক-না কেন, তাহার মা তো তাহাকে ভালোবাসে। অতএব দেখিতেছি, তাহাকেও ভালবাসা যায়, তবে আমি ভালোবাসিতে না পারি সে আমার অসম্পূর্ণতা।

যেমন, জড়ই বলো আর প্রাণীই বলো সকলেরই মধ্যে এক মহা চৈতন্যের নিয়ম কার্য করিতেছে, যাহাতে করিয়া উত্তরোত্তর প্রাণ অভিব্যক্ত হইয়া উঠিতেছে, তেমনি পাপীই বলো আর সাধুই বলো সকলেরই মধ্যে অসীম পুণ্যের এক আদর্শ বর্তমান থাকিয়া কার্য করিতেছে। স্বর্গের পাথেয় সকলেরই কাছে রহিয়াছে, কেহই তাহা হইতে বঞ্চিত নহে। তবে কেহ বা সোজা রাজপথে চলিয়াছে, কেহ বা নির্ব্বুদ্ধিতাবশতই হউক, কৌতূহলবশতই হউক, একবার মোড় ফিরিয়া গলির মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে, অবশেষে বহুক্ষণ ধরিয়া এ-গলি ও-গলি সে-গলি করিয়া পুনশ্চ সেই রাজপথে বাহির হইয়া পড়িতেছে, মাঝের হইতে পথ ও পথের কষ্ট বিস্তর বাড়িয়া যাইতেছে। কিন্তু জগতের সমুদয় পথই একই দিকে চলিয়াছে, তবে কোনটার বা ঘোর বেশী, কোনটার বা ঘোর কম এই যা তফাৎ।

অতএব পাপ বলিয়া যে একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে তাহা নহে। পাপীর যে ধার্মিকের চেয়ে বেশী কিছু আছে তাহা নহে, ধার্মিকের যতটা আছে পাপীর ততটা নাই এই পর্যন্ত। পাপীর ধর্মবুদ্ধি অচেতন অপরিণত। পাপ অভাব, পাপ মিথ্যা, পাপ মৃত্যু। অতএব আর সকলই থাকিবে, কেবল পাপ থাকিবে না—যেমন অন্ধকার-ঈথর কম্পনপ্রভাবে উত্তরোত্তর আলোক হইয়া উঠে, তেমনি পাপ চৈতন্যের প্রভাবে উত্তরোত্তর পুণ্যে পরিণত হইতে থাকিবে।

যাহা ধ্রুব তাহাই ধর্ম। এই ধ্রুবের আশ্রয়ে আছে বলিয়াই জগতের মৃত্যুভয় নাই। একটি ধ্রুবসূত্রে এই সমস্ত বিশ্বচরাচর মালার মতন গাঁথা রহিয়াছে। ক্ষুদ্রতম হইতে বৃহত্তম কিছুই সেই সূত্র হইতে বিচ্ছিন্ন নহে, অতএব সকলেই ধর্মের বাঁধনে বাঁধা। তবে, সেই বন্ধন সম্বন্ধে কেহ-বা সচেতন কেহ-বা অচেতন। অচেতনের বন্ধনই দাসত্ব, আর সচেতনের বন্ধনই প্রেম।