প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
অতএব দেখা যাইতেছে জগতের সমস্ত দৃশ্যের মধ্যে অনন্ত অদৃশ্য বর্তমান। নিত্যনূতন-নামক যে শব্দটা কবিরা ব্যবহার করিয়া থাকেন সেটা কি নিতান্ত একটা কথার কথা, একটা আলঙ্কারিক উক্তিমাত্র! তাহার মধ্যে গভীর সত্য আছে। অসীম যতই পুরাতন হউক্-না কেন তাহার নূতনত্ব কিছুতেই ঘুচে না! সে যতই পুরাতন হইতে থাকে ততই বেশী নূতন হইতে থাকে, সে দেখিতে যতই ক্ষুদ্র হউক্-না কেন প্রত্যহই তাহাকে অত্যন্ত অধিক করিয়া পাইতে থাকি। এই নিমিত্ত যথার্থ যে প্রেমিক সে আর নূতনের জন্য সর্ব্বদা লালায়িত নহে, শুদ্ধ তাহাই নয়, পুরাতন ছাড়িয়া সে থাকিতে পারে না। কারণ, নূতন অতি ক্ষুদ্র, পুরাতন অতি বৃহৎ। পুরাতন যতই পুরাতন হইতে থাকে ততই তাহার অসীম বিস্তার প্রেমিকের নিকট অবারিত হইতে থাকে,হৃদয় ততই তাহার মর্ম্মস্থানের অভিমুখে ক্রমাগত ধাবমান হইতে থাকে, ততই জানিতে পারা যায় হৃদয়ের বিচরণক্ষেত্রে অতি বৃহৎ, হৃদয়ের স্বাধীনতার কোথাও বাধা নাই। যে ব্যক্তি একবার এই পুরাতনের গভীরতার মধ্যে মগ্ন হইতে পারিয়াছে, এই সাগরের হৃদয়ে সন্তরণ করিতে পারিয়াছে, সে কি আর ছোট ছোট ব্যাংগুলার আনন্দ-কল্লোল শুনিয়া প্রতারিত হইয়া নূতন নামক সঙ্কীর্ণ কূপটার মধ্যে আপনাকে বদ্ধ করিতে পারে!
এ জগতে সকলি যে সমান, কেহ যে ছোট বড় নহে, তাহা প্রেমের চক্ষে ধরা পড়িল। এই নিমিত্ত যখন দেখা যায় যে, একজন লোক কুৎসিত মুখের দিকে অতৃপ্ত নয়নে চাহিয়া আছে, তখন আর আশ্চর্য্য হইবার কোন কারণ নাই—আর একজনকে দেখিতেছি সে সুন্দর মুখের দিকে ঠিক তেমনি করিয়াই চাহিয়া আছে, ইহাতেও আশ্চর্য্য হইবার কোন কথা নাই। অনুরাগের প্রভাবে উভয়ে মানুষের এমন স্থানে গিয়া পৌঁছিয়াছে যেখানে সকল মানুষই সমান, যেখানে কাহারো সহিত কাহারো এক চুল ছোট বড় নাই, যেখানে সুন্দর কুৎসিত প্রভৃতি তুলনা আর খাটেই না। সীমা এবং তুলনীয়তা কেবল উপরে, একবার যদি ইহা ভেদ করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিতে পার ত দেখিবে সেখানে সমস্তই একাকার, সমস্তই অনন্ত। এতবড় প্রাণ কাহার আছে সেখানে প্রবেশ করিতে পারে, বিশ্বচরাচরের মহাসমুদ্রে অসীম ডুব ডুবিতে পারে! প্রেমে সেই সমুদ্রে সন্তরণ করিতে শিখায় -যোহাকেই ভালবাস-না কেন তাহাতেই সেই মহাস্বাধীনতার ন্যূনাধিক আস্বাদ পাওয়া যায়। এই যে শূন্য অনন্ত আকাশ ইহাও আমাদের কাছে সীমাবদ্ধরূপে প্রকাশ পায়, মনে হয় যেন একটি অচল কঠিন সুগোল নীল মণ্ডপ আমাদিগকে ঘেরিয়া আছে; যেন খানিক দূর উঠিলেই আকাশের ছাতে আমাদের মাথা ঠেকিবে। কিন্তু ডানা থাকিলে দেখিতাম ঐ নীলিমা আমাদিগকে বাধা দেয় না, ঐ সীমা আমাদের চোখেরই সীমা; যদিও মণ্ডপের ঊর্ধ্বে আরও মণ্ডপ দেখিতাম; তদূর্দ্ধে উঠিলে আবার আর-একটা মণ্ডপ দেখিতাম, তথাপি জানিতে পারিতাম যে, উহারা আমাদিগকে মিথ্যা ভয় দেখাইতেছে, উহারা কেবল ফাঁকি মাত্র। আমাদের স্বাধীনতার বাধা আমাদের চক্ষু, কিন্তু বাস্তবিক বাধা কোথাও নাই।