ডুব দেওয়া
ডুবিবার স্থান

যখন একটা কুকুর একটি গোলাপ ফুল দেখে, তখন তাহার দেখা অতি শীঘ্রই ফুরাইয়া যায়—কারণ ফুলটি কিছু বড় নহে। কিন্তু এক জন ভাবুক যখন সেই ফুলটি দেখেন তখন তাঁহার দেখা শীঘ্র ফুরায় না, যদিও সে ফুলটি দেড় ইঞ্চি অপেক্ষা আয়ত নহে। কারণ, সে গোলাপ ফুলের গভীরতা নিতান্ত সামান্য নহে। যদিও তাহাতে দুই ফোঁটার বেশী শিশির ধরে না, তথাপি হৃদয়ের প্রেম তাহাকে যতই দাও-না কেন, তাহার ধারণ করিবার স্থান আছে। সে ক্ষুদ্রকায় বলিয়া যে তোমার হৃদয়কে তাহার বক্ষস্থিত কীটের মত গোটাকতক পাপড়ির মধ্যে কারারুদ্ধ করিয়া রাখে তাহা নহে। সে আরো তোমাকে এমন এক নূতন বিচরণের স্থানে লইয়া যায়, যেখানে এত বেশী স্বাধীনতা যে এক প্রকার অনির্দ্দেশ্য অনির্ব্বচনীয়তার মধ্যে হারা হইয়া যাইতে হয়। তখন এক প্রকার অস্ফুট দৈববাণীর মত হৃদয়ের মধ্যে শুনিতে পাওয়া যায়, যে সকলেরই মধ্যে অসীম আছে; যাহাকেই তুমি ভালবাসিবে সেই তোমাকে তাহার অসীমের মধ্যে লইয়া যাইবে, সেই তোমাকে তাহার অসীম দান করিবে। কে না জানেন, যাহাকে যত ভালবাসা যায় সে ততই বেশী হইয়া উঠে—নহিলে প্রেমিক কেন বলিবেন, “ জনম অবধি হম রূপ নেহারনু নয়ন না তিরপিত ভেল!” একটা মানুষ যত বড়ই হউক-না কেন, তাহাকে দেখিতে কিছু বেশীক্ষণ লাগে না—কিন্তু আজন্ম কাল দেখিয়াও যখন দেখা ফুরায় না তখন সে না-জানি কত বড় হইয়া উঠিয়াছে। ইহার অর্থ আর কিছুই নহে, অনুরাগের প্রভাবে প্রেমিক একজন মানুষের অন্তরস্থিত অসীমের মধ্যে প্রবেশাধিকার পাইয়াছেন, সেখানে সে মানুষের আর অন্ত পাওয়া যায় না; হৃদয় যতই দাও ততই সে গ্রহণ করে, যত দেখ ততই নতুন দেখা যায়, যত তোমার ক্ষমতা আছে ততই তুমি নিমগ্ন হইতে পার। এই জন্যই যথার্থ অনুরাগের মধ্যে এক প্রকার ব্যাকুলতা আছে। সে এতখানি পায় যে, তাহা প্রাণ ভরিয়া আয়ত্ত করিতে পারে না—তাহার এত বেশী তৃপ্তি বর্তমান যে, সে তৃপ্তিকে সে সর্ব্বতোভাবে অধিকার করিতে পারে না ও তাহা সুমধুর অতৃপ্তিরূপে চতুর্দ্দিক পূর্ণ করিয়া বিরাজ করিতে থাকে। যেখানে অনুরাগ নাই সেইখানেই সীমা, সেইখানেই মহা অসীমের দ্বার রুদ্ধ, সেইখানেই চারি দিকে লৌহের ভিত্তি, কারাগার! জগৎকে যে ভালবাসিতে শিখে নাই সে ব্যক্তি অন্ধকূপের মধ্যে আট্‌কা পড়িয়াছে। সে মনে করিতেও পারে না এইটুকুর বাহিরেও কিছু থাকিতে পারে। তাহার নিজের পায়ের শিক্‌লিটার ঝম্‌ ঝম্‌ শব্দই তাহার জগতের একমাত্র সঙ্গীত। সে কল্পনাও করিতে পারে না কোথাও পাখী ডাকে, কোথাও সূর্যের কিরণ বিকীরিত হয়।

অনুরাগেই যে যথার্থ স্বাধীনতা তাহার একটা প্রমাণ দেওয়া যাইতে পারে। সম্পূর্ণ নূতন লোকের মধ্যে গিয়া পড়িলে আমরা যেন নিশ্বাস লইতে পারি না, হাত পা ছড়াইতে সঙ্কোচ হয়, যে কেহ লোক থাকে সকলেই যেন বাধার মত বিরাজ করিতে থাকে, তাহারা সদয় ব্যবহার করিলেও সকল সময়ে মনের সঙ্কোচ দূর হয় না। তাহার কারণ, একমাত্র অনুরাগের অভাববশতঃ আমরা তাহাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করিতে পাই না, যেখানে স্বাধীনতার যথার্থ বিচরণ-ভূমি সে স্থান আমাদের নিকটে রুদ্ধ। আমরা কেবলি তাহাদের নাকে চোখে মুখে, আচারে ব্যবহারে, নূতন ধরণের কথায় বার্ত্তায় হুঁচট ঠোকর ধাক্কা খাইতে থাকি।