মুক্তির উপায়

পুষ্প। ভাই হৈমি, ফকিরদার ইড়াপিঙ্গলা আজকাল কী রকম আওয়াজ দিচ্ছে।

হৈম। খুব জোরে। মনে হয়, পেটের মধ্যে তিনটে চারটে ব্যাঙ মরিয়া হয়ে উঠেছে।

ফকির। ঐ দেখো, শুনলে পুষ্পদিদি? আশ্চর্য ব্যাপার! সত্যি কথা না জেনেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। গুরুজি বলে দিয়েছেন, মাণ্ডূক্য উপনিষদের ডাকটাই হচ্ছে ব্যাঙের ডাক। অন্তরাত্মা চরম অবস্থায় নাভীগহ্বরে প্রবেশ করে হয়ে পড়েন কূপমণ্ডূক, চার দিকের কিছুতেই আর নজর পড়ে না। তখনি পেটের মধ্যে কেবলই শিবোহং শিবোহং শিবোহং করে নাড়িগুলো ডাক ছাড়তে থাকে। সেই ঘুমেতে কী গভীর আনন্দ সে আমিই জানি— যোগনিদ্রা একেই বলে।

হৈম। একদিন মিন্তু কেঁদে উঠে ওঁর সেই ব্যাঙডাকা ঘুম ভাঙিয়ে দিতেই তাকে মেরে খুন করেন আর কি!

পুষ্প। ফকিরদা, সংস্কৃতে অনার্স নিয়েছিলুম, আমাকে পড়তে হয়েছিল মাণ্ডূক্যের কিছু কিছু। নাকের মধ্যে গোলমরিচের গুঁড়ো দিয়ে হেঁচে হেঁচে ঘুম ভাঙিয়ে রাখতে হত। হাঁচির চোটে নিরেট ব্রহ্মজ্ঞানের বারো আনা তরল হয়ে নাক দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিল। ইড়াপঙ্গলা রইল বেকার হয়ে। অভাগিনী আমি, গুরুর ফুঁয়ের জোরে অজ্ঞানসমুদ্র পার হতে পারলেম না।

ফকির। (ঈষৎ হেসে) অধিকারভেদ আছে।

পুষ্প। আছে বই কি। দেখো-না, ঐ শাস্ত্রেই ঋষি কোন্‌-এক শিষ্যকে দেখিয়ে বলেছেন, সোয়মাত্মা চতুষ্পাৎ— এর আত্মাটা চার-পা-ওয়ালা। অধিকারভেদকেই তো বলে দু-পা চার-পায়ের ভেদ। হৈম, রাত্রে তো ব্যাঙের ডাক শুনে জেগে থাকিস, আর কোনো জাতের ডাক শুনিস কি দিনের বেলায়।

হৈম। কী জানি ভাই, মিন্তু দৈবাৎ ওঁর মন্ত্রপড়া জলের ঘটি উলটিয়ে দিতেই উনি যে হাঁক দিয়ে উঠেছিলেন সেটা—

পুষ্প। হাঁ, সেটা চারপেয়ে ডাক। মিলছে এই শাস্ত্রের সঙ্গে।

ফকির। সোহং ব্রহ্ম, সোহং ব্রহ্ম, সোহং ব্রহ্ম।

পুষ্প। ফকিরদা, তপস্যা যখন ভেঙেছিল শিব এসেছিলেন তাঁর বরদাত্রীর কাছে— তোমার তপস্যা এবার গুটিয়ে নাও; এই দেখো, বরদাত্রী অপেক্ষা করে আছেন লালপেড়ে শাড়িখানি পরে।

হৈমবতী। পুষ্পদিদি, বরদাত্রীর জন্যে ভাবনা নেই; পাড় দেখা দিচ্ছে রঙ-বেরঙের।

পুষ্প। বুঝেছি, গেরুয়া রঙের ছটা বুঝি ঘরের দেয়াল পেরিয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে?

হৈমবতী। এরই মধ্যে আসতে আরম্ভ করেছেন দুটি একটি করে বরদাত্রী। গেরুয়া রঙের নেশা মেয়েরা সামলাতে পারে না। পোড়াকপালীদের মরণদশা আর কি! সেদিন এসেছিল একজন বেহায়া মেয়ে ওঁর কাছে মুক্তিমন্ত্র নেবে ব’লে। হবি তো হ, আমারই ঘরে এসে পড়েছিল— দুটো-একটা খাঁটি কথা শুনিয়েছিলুম, মুক্তিমন্ত্রেরই কাজ করেছিল, গেল মাথা ঝাঁকানি দিয়ে বেরিয়ে।

ফকির। দেখো, আমার মাণ্ডূক্যটা দাও।

পুষ্প। কী করবে।

ফকির। নারীর হাত লেগেছে, গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে আনিগে।

পুষ্প। সেই ভালো, বুদ্ধি দিয়ে ধোওয়াটা তো হল না এ জন্মে।

ফকির। শুনে যাও, হৈম। আজকে গুরুগৃহে নবরত্নদান ব্রত। আমি তাঁকে দেব সোনা, একটা গিনি চাই।

হৈমবতী। দিতে পারব না, শ্বশুরমশায় পা ছুঁইয়ে বারণ করেছেন।

পুষ্প। তোমার গুরুজির বুঝি কাঞ্চনে অরুচি নেই!

ফকির। তাঁর মহিমা কী বুঝবে তোমরা! কাঞ্চন পড়তে থাকে তাঁর ঝুলির মধ্যে আর তিনি চোখ বুজে বলেন— হুং ফট্‌।