দুই বোন
স্নানাহারের সময় যায় পিছিয়ে, ঊর্মির উচ্চহাসির স্বরোচ্ছ্বাসে সমস্ত বাড়ি মুখরিত। শেষকালে শশাঙ্কের অস্বাস্থ্য-আশঙ্কায় দূতের পরে দূত পাঠিয়ে শর্মিলা এদের নিবৃত্ত করলে।

দিন গেছে। রাত্রি হয়েছে অনেক। পুষ্পিত কৃষ্ণচূড়ার শাখাজাল ছাড়িয়ে পূর্ণচাঁদ উঠেছে অনাবৃত আকাশে। হঠাৎ ফাল্গুনের দমকা হাওয়ায় ঝর্‌ঝর্‌ শব্দে দোলাদুলি করে উঠেছে বাগানের সমস্ত গাছপালা, তলাকার ছায়ার জাল তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে। জানলার কাছে ঊর্মি চুপ করে বসে। ঘুম আসছে না কিছুতেই। বুকের মধ্যে রক্তের দোলা শান্ত হয় নি। আমের বোলের গন্ধে মন উঠেছে ভরে। আজ বসন্তে মাধবীলতার মজ্জায় মজ্জায় যে ফুল ফোটাবার বেদনা সেই বেদনা যেন ঊর্মির সমস্ত দেহকে ভিতর থেকে উৎসুক করেছে। পাশের নাবার ঘরে গিয়ে মাথা ধুয়ে নিলে, গা মুছলে ভিজে তোয়ালে দিয়ে। বিছানায় শুয়ে এ-পাশ ও-পাশ করতে করতে কিছুক্ষণ পরে স্বপ্নজড়িত ঘুমে আবিষ্ট হয়ে পড়ল।

রাত্রি তিনটের সময় ঘুম ভেঙেছে। চাঁদ তখন জানলার সামনে নেই। ঘরে অন্ধকার, বাইরে আলোয় ছায়ায় জড়িত সুপারিগাছের বীথিকা। ঊর্মির বুক ফেটে কান্না এল, কিছুতে থামতে চায় না। উপুড় হয়ে পড়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল। প্রাণের এই কান্না-- ভাষায় এর শব্দ নেই, অর্থ নেই। প্রশ্ন করলে ও কি বলতে পারে, কোথা থেকে এই বেদনার জোয়ার উদ্‌বেলিত হয়ে ওঠে ওর দেহে মনে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় দিনের কর্মতালিকা, রাত্রের সুখনিদ্রা?

সকালে ঊর্মি যখন ঘুম ভেঙে উঠল তখন ঘরের মধ্যে রৌদ্র এসে পড়েছে। সকালবেলাকার কাজে ফাঁক পড়ল, ক্লান্তির কথা মনে করে শর্মিলা ওকে ক্ষমা করেছে। কিসের অনুতাপে ঊর্মি আজ অবসন্ন। কেন মনে হচ্ছে, ওর হার হতে চলল। দিদিকে গিয়ে বললে, “দিদি, আমি তো তোমার কোনো কাজ করতেই পারি নে-- বল তো বাড়ি ফিরে যাই!”

আজ তো শর্মিলা বলতে পারলে না ‘না, যাস নে’। বললে, “আচ্ছা, যা তুই। তোর পড়াশুনোর ক্ষতি হচ্ছে। যখন মাঝে মাঝে সময় পাবি দেখে-শুনে যাস।”

শশাঙ্ক তখন কাজে বেরিয়ে গেছে। সেই অবকাশে সেই দিনই ঊর্মি বাড়ি চলে গেল।

শশাঙ্ক সেদিন যান্ত্রিক ছবি আঁকার এক-সেট সরঞ্জাম কিনে বাড়ি ফিরলে। ঊর্মিকে দেবে, কথা ছিল তাকে এই বিদ্যেটা শেখাবে। ফিরে এসে তাকে যথাস্থানে না দেখতে পেয়ে শর্মিলার ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করল,“ঊর্মি গেল কোথায়।”

শর্মিলা বললে, “এখানে তার পড়াশুনোর অসুবিধে হচ্ছে বলে সে বাড়ি চলে গেছে।”

“কিছু দিন অসুবিধে করবে বলে সে তো প্রস্তুত হয়েই এসেছিল। অসুবিধের কথা হঠাৎ আজই মনে উঠল কেন।”

কথার সুর শুনে শর্মিলা বুঝলে শশাঙ্ক তাকেই সন্দেহ করছে। সে সম্বন্ধে কোনো বৃথা তর্ক না করে বললে, “আমার নাম করে তুমি তাকে ডেকে নিয়ে এসো, নিশ্চয় কোনো আপত্তি করবে না।”

ঊর্মি বাড়িতে ফিরে এসে দেখলে, অনেক দিন পরে বিলেত থেকে ওর নামে নীরদের চিঠি এসে অপেক্ষা করছে। ভয়ে খুলতেই পারছিল না। মনে জানে, নিজের তরফে অপরাধ জমা হয়ে উঠেছে। নিয়মভঙ্গের কৈফিয়ত-স্বরূপ এর আগে দিদির রোগের উল্লেখ করেছিল। কিছুদিন থেকে কৈফিয়তটা প্রায় এসেছে মিথ্যে হয়ে। শশাঙ্ক বিশেষ জেদ করে শর্মিলার জন্যে দিনে একজন রাত্রে একজন নার্স নিযুক্ত করে দিয়েছে। ডাক্তারের বিধান-মতে রোগীর ঘরে সর্বদা আত্মীয়দের আনাগোনা তারা রোধ করে। ঊর্মি মনে জানে নীরদ দিদির রোগের কৈফিয়তটাকেও গুরুতর মনে করবে না; বলবে ‘ওটা কোন কাজের কথা নয়।’ বস্তুতই কাজের কথা নয়—‘আমাকে তো দরকার হচ্ছে না’। অনুতপ্তচিত্তে স্থির করলে, ‘এবারে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইব। বলব, আর কখনো ত্রুটি হবে না, কিছুতে নিয়মভঙ্গ করব না।’

চিঠি খোলবার আগে অনেক দিন পরে আবার বের করলে সেই ফোটোগ্রাফখানা। টেবিলের উপর রেখে দিলে। জানে ঐ