দুই বোন

ঊর্মি কটাক্ষ করে বলেছিল, “ভগবান মনু তবে কাকে প্রয়োগ করতে বলেন।”

শশাঙ্ক গম্ভীর মুখে বললে, “অসম্মানের সনাতন অধিকার ভগ্নীপতির। আমার পাওনা আছে। সেটা সুদে ভারী হয়ে উঠল।”

“মনে তো পড়ছে না।”

“পড়বার কথা নয়, তখন ছিলে নিতান্ত নাবালিকা। সেই কারণেই তোমার দিদির সঙ্গে শুভলগ্নে যেদিন এই সৌভাগ্যবানের বিবাহ হয়, সেদিন বাসররজনীর কর্ণধারপদ গ্রহণ করতে পার নি। আর সেই কোমল করপল্লবের অরচিত কান-মলাটাই রূপ গ্রহণ করছে সেই করপল্লবরচিত জুতোযুগল। ওটার প্রতি আমার দাবি রইল জানিয়ে রেখে দিলুম।”

দাবি শোধ হয় নি, সে জুতো যথাসময়ে প্রণামীরূপে নিবেদিত হয়েছিল দাদার চরণে। তার পর কিছুকাল পরে শশাঙ্কর কাছ থেকে ঊর্মি একখানি চিঠি পেল। পেয়ে খুব হেসেছে সে। সেই চিঠি আজও তার বাক্সে আছে; আজ খুলে সে আবার পড়লে-

কাল তো তুমি চলে গেলে। তোমার স্মৃতি পুরাতন হতে না হতে তোমার নামে একটা কলঙ্ক রটনা হয়েছে, সেটা তোমার কাছে গোপন করা অকর্তব্য মনে করি।

আমার পায়ে একজোড়া তালতলীয় চটি অনেকেই লক্ষ করেছে। কিন্তু তার চেয়ে লক্ষ করেছে তার ছিদ্র ভেদ করে আমার চরণনখরপঙ্‌ক্তি মেঘমুক্ত চন্দ্রমালার মতো। (ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল দ্রষ্টব্য। উপমার যাথার্থ্য সম্বন্ধে সন্দেহ ঘটলে তোমার দিদির কাছে মীমাংসনীয়।) আজ সকালে আমার আপিসের বৃন্দাবন নন্দী যখন আমার সপাদুক চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করলে তখন আমার পদমর্যাদায় যে বিদীর্ণতা প্রকাশ পেয়েছে তারই অগৌরব মনে আন্দোলিত হল। সেবককে জিজ্ঞাসা করলেম, ‘মহেশ, আমার সেই অন্য নূতন চটিজোড়াটা গতিলাভ করেছে অন্য কোন্‌ অনধিকারীর শ্রীচরণে।’ সে মাথা চুলকিয়ে বললে, ‘ও বাড়ির ঊর্মিমাসিদের সঙ্গে আপনিও যখন দার্জিলিঙ যান সেই সময়ে চটিজোড়াটাও গিয়েছিল। আপনি ফিরে এসেছেন সেইসঙ্গে ফিরে এসেছে তার একপাটি, আর-এক পাটি--‘ তার মুখ লাল হয়ে উঠল। আমি এক ধমক দিয়ে বললুম, ‘ব্যস, চুপ।’ সেখানে অনেক লোক ছিল। চটিজুতো-হরণ হীনকার্য। কিন্তু মানুষের মন দুর্বল, লোভ দুর্দম, এমন কাজ করে ফেলে, ঈশ্বর বোধ করি ক্ষমা করেন। তবু অপহরণ-কাজে বুদ্ধির পরিচয় থাকলে দুষ্কার্যের গ্লানি অনেকটা কাটে। কিন্তু একপাটি চটি!!! ধিক্‌!!!

যে এ কাজ করেছে, যথাসাধ্য তার নাম আমি উহ্য রেখেছি। সে যদি তার স্বভাবসিদ্ধ মুখরতার সঙ্গে এই নিয়ে অনর্থক চেঁচামেচি করে তা হলে কথাটা ঘাঁটাঘাঁটি হয়ে যাবে। চটি নিয়ে চটাচটি সেইখানেই খাটে যেখানে মন খাঁটি। মহেশের মতো নিন্দুকের মুখ বন্ধ এখনই করতে পার একজোড়া শিল্পকার্যখচিত চটির সাহায্যে। যেমন তার আস্পর্ধা!

পায়ের মাপ এইসঙ্গে পাঠাচ্ছি।

চিঠিখানি পেয়ে ঊর্মি স্মিতমুখে পশমের জুতো বুনতে বসেছিল, কিন্তু শেষ করে নি। পশমের কাজে আর তার উৎসাহ ছিল না। আজ এটা আবিষ্কার করে স্থির করলে এই অসমাপ্ত জুতোটাই দেবে শশাঙ্ককে সেই দার্জিলিঙ যাত্রার সাম্বৎসরিক দিনে। সেদিন আর কয়েক সপ্তাহ পরেই আসছে। গভীর একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল-হায় রে, কোথায় সেই হাস্যোজ্জ্বল আকাশে হালকা পাখায় উড়ে-যাওয়া দিনগুলি! এখন থেকে সামনে প্রসারিত নিরবকাশ কর্তব্যকঠোর মরুজীবন।

আজ ২৬শে ফাল্গুন। হোলিখেলার দিন। মফঃস্বলের কাজে এ খেলায় শশাঙ্কের সময় ছিল না, এদিনের কথা তারা ভুলেই গেছে। ঊর্মি আজ তার শয্যাগত দিদির পায়ে আবীরের টিপ দিয়ে প্রণাম করেছে। তার পরে খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখলে, শশাঙ্ক আপিস-ঘরের ডেস্কে ঝুঁকে পড়ে একমনে কাজ করছে। পিছন থেকে গিয়ে দিলে তার মাথায় আবীর মাখিয়ে, রাঙিয়ে উঠল তার কাগজপত্র। মাতামাতির পালা পড়ে গেল। ডেস্কে ছিল দোয়াতে লাল কালি। শশাঙ্ক দিলে ঊর্মির শাড়িতে ঢেলে। হাত চেপে ধরে তার আঁচল থেকে ফাগ কেড়ে নিয়ে ঊর্মির মুখে দিলে ঘষে, তার পরে দৌড়াদৌড়ি, ঠেলাঠেলি, চেঁচামেচি। বেলা যায় চলে,