বাঙলা ছন্দের প্রকৃতি
                                    কেবল খাব খোল বিচিলি ঘাস।
                 যেন       রাঙা আমলা তুলে মামলা
                                   গামলা ভাঙে না,
               আমরা    ভুষি পেলেই খুশি হব
                                ঘুষি খেলে বাঁচব না।
কেবল এর হাসিটি নয়, এর ছন্দের বিচিত্র ভঙ্গিটা লক্ষ্য করে দেখবার বিষয়।

অথচ, এই প্রাকৃত-বাংলাতেই ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য লিখলে যে বাঙালিকে লজ্জা দেওয়া হত সে কথা স্বীকার করব না। কাব্যটা এমন ভাবে আরম্ভ করা যেত–

যুদ্ধ যখন সাঙ্গ হল বীরবাহু বীর যবে
বিপুল বীর্য দেখিয়ে হঠাৎ গেলেন মৃত্যুপুরে
যৌবনকাল পার না হতেই, কও মা সরস্বতী,
অমৃতময় বাক্য তোমার, সেনাধ্যক্ষপদে
কোন্‌ বীরকে বরণ করে পাঠিয়ে দিলেন রণে
রঘুকুলের পরম শত্রু, রক্ষকুলের নিধি।
এতে গাম্ভীর্যের ত্রুটি ঘটেছে এ কথা মানব না। এই যে-বাংলা বাঙালির দিনরাত্রির ভাষা এর একটি মস্ত গুণ, এ ভাষা প্রাণবান্‌। এইজন্যে সংস্কৃত বল, পারসি বল, ইংরেজি বল, সব শব্দকেই প্রাণের প্রয়োজনে আত্মসাৎ করতে পারে। খাঁটি হিন্দি ভাষারও সেই গুণ। যারা হেড্‌পণ্ডিত মশায়ের কাছে পড়ে নি তাদের একটা লেখা তুলে দিই–

চক্ষু আঁধার দিলের ধোঁকায়

কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়,

কী রঙ্গ সাঁই দেখছে সদাই

বসে নিগম ঠাঁই।

এখানে না দেখলেম তারে

চিনব তবে কেমন ক ' রে,

ভাগ্যেতে আখেরে তারে

চিনতে যদি পাই।

প্রাকৃত-বাংলাকে গুরুচণ্ডালি দোষ স্পর্শই করে না। সাধু ছাঁদের ভাষাতেই শব্দের মিশোল সয় না।

চলতি বাংলাভাষার প্রসঙ্গটা দীর্ঘ হয়ে পড়ল। তার কারণ, এ ভাষাকে যাঁরা প্রতিদিন ঘরে দেন স্থান, তাঁদের অনেকে সাহিত্যে একে অবজ্ঞা করেন। সেটাতে সাহিত্যকে তার প্রাণরসের মূল আধার থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে জেনে আমার আপত্তিকে বড়ো করেই জানালুম। ছন্দের তত্ত্ববিচারে ভাষার অন্তর্নিহিত ধ্বনিপ্রকৃতির বিচার অত্যাবশক, সেই কথাটা এই উপলক্ষ্যে বোঝাবার চেষ্টা করেছি।

বাংলা ছন্দের তিনটি শাখা। একটি আছে পুঁথিগত কৃত্রিম ভাষাকে অবলম্বন করে, সেই ভাষায় বাংলার স্বাভাবিক ধ্বনিরূপকে স্বীকার করে নি। আর-একটি সচল বাংলার ভাষাকে নিয়ে, এই ভাষা বাংলার হসন্ত-শব্দের ধ্বনিকে আপন বলে গ্রহণ করেছে।