বৈকুন্ঠের খাতা

প্রত্যাশাও করে নি। দিব্যি আছি।

অবিনাশ। আচ্ছা, সে থাক্‌—কিন্তু, দেখো তিনকড়ি, মনোরমাকে আমি একটি আংটি উপহার দেব। বুঝলে? সেইসঙ্গে এক লাইন চিঠি দিতে চাই—

তিনকড়ি। ক্ষতি কী! একটা লাইন বৈ তো নয়, চট করে হয়ে যাবে।

অবিনাশ। এই দেখো-না, আমি লিখেছিলুম—‘দেবীপদতলে বিমুগ্ধ ভক্তের পূজোপহার’। তুমি কী বল?

তিনকড়ি। তোমার কথা তুমি বলবে, ওর মধ্যে আমার কিছু বলা ভালো হয় না, সে হল আমার ভগ্নী—

অবিনাশ। না না, তা বলছি নে। আংটি কি ঠিক পদতলে দেওয়া যায়! করতলে লিখলে—

তিনকড়ি। তা, ওটা লেখা বৈ তো না—পদতলে লিখে করতলে দিলেই হবে, সেজন্যে তো কেউ আদালতে নালিশ করবে না।

অবিনাশ। না হে না, লেখার তো একটা মানে থাকা চাই—

তিনকড়ি। আংটি থাকলে আর মানে থাকার দরকার কী? ওতেই তো বোঝা গেল।

অবিনাশ। আংটির চেয়ে কথার দাম বেশি, তা জান?

তিনকড়ি। তা হলে আজ আর তিনকড়েকে হাহাকার করে বেড়াতে হত না।

অবিনাশ। আঃ, কী বকছ তুমি তার ঠিক নেই। একটু মন দিয়ে শোনো দেখি। ও লাইনটা যদি এইরকম লেখা যায় তো কেমন হয়—‘প্রেয়সীর করপদ্মে অনুরক্ত সেবকের প্রণয়োপহার’।

তিনকড়ি। বেশ হয়।

অবিনাশ। বেশ হয়! একটা কথা বলে দিলেই হল—‘বেশ হয়’! একটু ভেবেচিন্তে বলো-না!

তিনকড়ি। ও বাবা! এ যে আবার রাগ করে! বুড়োর শরীরে কিন্তু রাগ নেই। (প্রকাশ্যে) তা, ভেবেচিন্তে দেখলে বোধ হয় গোড়ারটাই ছিল ভালো।

অবিনাশ। কেন বলো দেখি। এটাতে কী দোষ হয়েছে।

তিনকড়ি। ও বাবা! এটাতে যদি দোষই না থাকবে তো খামকা আমাকে ভাবতে বললে কেন? এ তো বড়ো মুশকিলেই পড়া গেল দেখছি।—দোষ কী জানেন অবিনাশবাবু,ও ভাবতে গেলেই দোষ, না ভাবলে কিছুতেই দোষ নেই, আমি তো এই বুঝি।

অবিনাশ। ওঃ, বুঝেছি—তুমি বলছ, আগে থাকতে ঐ প্রেয়সী সম্বোধনটায় লোকে কিছু মনে ভাবতে পারে—

তিনকড়ি। বাঁচা গেল!—হাঁ, তাই বটে। কিন্তু কী জানেন, আপনা-আপনির মধ্যে নাহয় তাকে প্রেয়সীই বললেন! তা কি আর অন্য কেউ বলে না! ঐটেই লিখে ফেলুন।

অবিনাশ। কাজ নেই, গোড়ায় যেটা ছিল সেইটেই—

তিনকড়ি। সেইটেই তো আমার পছন্দ—

অবিনাশ। কিন্তু একটু ভেবে দেখো-না, ওটা যেন—

তিনকড়ি। ও বাবা! আবার ভাবতে বলে!— দেখো অবিনাশবাবু, শিশুকাল থেকে আমিও কারোও জন্যে ভাবি নি, আমার জন্যেও কেউ ভাবে নি, ওটা আমার আর অভ্যাস হলই না। এরকম আরো আমার অনেকগুলি শিক্ষার দোষ আছে—

অবিনাশ। আঃ, তিনকড়ি, তুমি একটু থামলে বাঁচি। নিজের কথা নিয়েই কেবল বকবক করে মরছ, আমাকে একটু ভাবতে দাও দেখি।