বাংলাভাষা-পরিচয় ১৭

‘হতে’ আর ‘থেকে’ এই দুটো শব্দ বাংলা অপাদানের সম্বল। প্রাচীন হিন্দিতে ‘হতে’ শব্দের জুড়ি পাওয়া যায় ‘হুন্তো’, নেপালিতে ‘ভন্দা’, সংস্কৃত ‘ভবন্ত’। প্রাচীন রামায়ণে দেখেছি : ঘরে হনে, ভূমি হনে।

অপভ্রংশ প্রাকৃতের অপাদানে পাওয়া যায় : হোংতও হোংতউ। ‘থেকে’ শব্দটার ধ্বনিসাদৃশ্য পাওয়া যায় নেপালিতে, যেমন : ‘তাঁহা দেখি = সেখান থেকে, মাঝ দেখি = মাঝ থেকে।’ গুজরাটিতে আছে ‘থকি’। বাংলায় অপাদানে একটা গ্রাম্য প্রয়োগ আছে ‘ঠেঞে’ (ঠাঁই হতে), যথা : তোমার ঠেঞে কিছু আদায় করতে হবে।

একদা পালি ব্যাকরণে পেয়েছিলুম ‘অজ্জতগ্‌গে’ শব্দ। এর সংস্কৃত মূল ‘অদ্যতঃ অগ্রে’; ‘আজ থেকে’ শব্দের সঙ্গে এর ধ্বনি ও অর্থের মিল আছে। জানি নে পণ্ডিতদের কাছে এ ইঙ্গিত গ্রাহ্য হবে কি না।

এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে। ‘পশুর থেকে মানুষের উৎপত্তি’ এ কথা বলা চলে। কিন্তু ‘মানুষ থেকে গন্ধ বেরচ্ছে’ বলি নে, বলি ‘মানুষের গা থেকে’ কিংবা ‘কাপড় থেকে’। ‘বিপিন থেকে টাকা পেয়েছি’ বলা চলে না, বলতে হয় ‘বিপিনের কাছ থেকে টাকা পেয়েছি’। এর কারণ, অচেতন পদার্থের নামের সঙ্গেই ‘থেকে’ শব্দের সাক্ষাৎ সম্বন্ধ। তাই ‘মেঘ থেকে’ বৃষ্টি নামে, ‘পাখি থেকে’ গান ওঠে না, ‘পাখির কণ্ঠ থেকে’ গান ওঠে।

কেবল ‘থেকে’ নয়, ‘হতে’ শব্দ-প্রয়োগেও ঐ একই কথা। ‘অযোধ্যা হতে’ রাম নির্বাসিত হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন ‘রাবণের কাছ হতে’।

তুলনামুলক অর্থেও ব্যবহৃত হয় : হতে থাকে চেয়ে চাইতে।

অন্য প্রসঙ্গে সম্বন্ধপদের আলোচনা হয়ে গেছে। এক কালে বহুবচনে সম্বন্ধপদের ‘দিগের’ শব্দের পূর্বেও সম্বন্ধের আর-একটা বিভক্তি থাকত, যেমন ‘আমারদিগের’।

বাংলা সম্বন্ধপদের একটা প্রত্যয় আছে ‘কার’। এর ব্যবহার সার্বত্রিক নয়। সময়-বাচক ক্রিয়াবিশেষণে ‘এখন’ ‘তখন’ ‘যখন’ ‘কখন’এর সঙ্গে ‘কার’ জোড়া হয়। বিশেষ কোনো ‘বেলাকার’ ‘দিনকার’ ‘রাতকার’ও চলে। ‘আজ’ এবং ‘কাল’ শব্দে কর্মকারকের বিভক্তির সঙ্গে যোগ করে ওর ব্যবহার : আজকেকার কালকেকার। ‘পর্শুকার’, অমুক ‘হপ্তাকার’ বা ‘বছরকার’ হয়, কিন্তু অমুক ‘মাসকার’ কিংবা অমুক ‘ঘণ্টাকার’ হয় না। ‘সকলকার’ হয়, ‘সমস্তকার’ হয় না। ‘সত্যকার’ হয়, ‘মিথ্যাকার’ হয় না। ভিতরকার বাহিরকার উপরকার নিচেকার এদিককার ওদিককার এধারকার ওধারকার— চলে। ব্যক্তি বা বস্তুবাচক শব্দ সম্পর্কে এর ব্যবহার নেই। ‘জন’ শব্দ যোগে সংখ্যাবাচক শব্দে ‘কার’ প্রয়োগ হয় : একজনকার দুজনকার। কিন্তু ‘জন’ ছাড়া মনুষ্যবাচক আর-কোনো শব্দের সঙ্গে ওর যোগ নেই। ‘ইংরেজকার’ বলা চলে না।