বাংলাভাষা-পরিচয় ১৩

আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্র যতই বেড়ে চলেছে ততই দেখতে পাচ্ছি, আমাদের চলতি ভাষার কারখানায় জোড়তোড়ের কৌশলগুলো অত্যন্ত দুর্বল। বিশেষ্যকে বিশেষণ বা ক্রিয়াপদে পরিণত করবার সহজ উপায় আমাদের ভাষায় নেই বললেই হয়। তাই বাংলা ভাষার আপন রীতিতে নতুন শব্দ বানানো প্রায় অসাধ্য। সংস্কৃত ভাষায় কতকগুলো টুকরো শব্দ আছে যেগুলোর স্বতন্ত্র কাজ নেই, তারা বাক্যের লাইন বদলিয়ে দেয়। রেলের রাস্তায় যেমন সিগ্‌ন্যাল, ভিন্ন দিকে ভিন্ন রঙের আলোয় তাদর ভিন্ন রকমের সংকেত, সংস্কৃত ব্যাকরণের উপসর্গগুলো শব্দের মাথায় চড়া সেইরকম সিগ্‌ন্যাল। কোনোটাতে আছে নিষেধ, কোনোটা দেখায় এগোবার পথ, কোনোটা বাইরের পথ, কোনোটা নীচের দিকে, কোনোটা উপরের দিকে, কোনোটা চার দিকে, কোনোটা ডাকে ফিরে আসতে। ‘গত’ শব্দে আ উপসর্গ জুড়ে দিলে হয় ‘আগত’, সেটা লক্ষ্য করায় কাছের দিক; নির্‌ জুড়ে দিলে হয় ‘নির্গত’, দেখিয়ে দেয় বাইরের দিক; অনু জুড়ে দিলে হয় ‘অনুগত’, দেখিয়ে দেয় পিছনের দিক; তেমনি ‘সংগত’ ‘দুর্গত’ ‘অপগত’ প্রভৃতি শব্দে নানা দিকে তর্জনী চালানো। উপসর্গ থাকে সামনে, প্রত্যয় থাকে পিছনে। তারা আছে একই শব্দের নানা অর্থ বানাবার কাজে। নতুবা শব্দ তৈরি করবার বেলায় তাদের নইলে চলে না।

শব্দগড়নের কাজে বাংলাতেও কতকগুলো প্রত্যয় পাওয়া যায়। তার একটার দৃষ্টান্ত অন, যার থেকে হয়েছে : চলন বলন গড়ন ভাঙন। এরই সহকারী আ প্রত্যয়, যার থেকে পাওয়া যায় বিশেষ্য পদে : চলা বলা গড়া ভাঙা। এই প্রত্যয়টা বাংলায় সবচেয়ে সাধারণ, প্রায় সব ক্রিয়াতেই এদের জোড়া যায়। এই আ প্রত্যয় বিশেষণেও লাগে, যেমন : ঠেলা গাড়ি, ভাঙা রাস্তা। কিন্তু তি দিয়ে একটা প্রত্যয় আছে যেটা বিশেষভাবে বিশেষণেরই, যেমন : চলতি গাড়ি, কাটতি মাল, ঘাটতি ওজন। মুশকিল এই যে, সব জায়গাতেই কাজে লাগাতে পারি নে, কেন পারি নে তারও স্পষ্ট কৈফিয়ত পাওয়া যায় না। ‘গড়তি টেবিল’ কিংবা ‘কথা-কইতি খোকা’ বলতে মুখে বাধে, এর কোনো সংগত কারণ ছিল না। কাজ চালাবার জন্যে অন্য কোনো প্রত্যয় খুঁজতে হয়, সব সময়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। যে টেবিল গড়া চলছে তাকে সংস্কৃতে বোধ হয় ‘সংঘটমান’ বলা চলে, কিন্তু বাংলায় কিছু হাৎড়ে পাই নে। যে খোকা কথা কয় ইএ প্রত্যয়ের সাহায্যে তাকে ‘কথা-কইয়ে’ বলা যেতে পারে। অথচ ঐ প্রত্যয় দিয়ে ‘হাসিয়ে’ ‘কাঁদিয়ে’ বলা নিষিদ্ধ। কাঁদার বেলায় আর-এক প্রত্যয় খুঁজে পাওয়া যায় উনে, ‘কাঁদুনে’। কিন্তু ‘হাসুনে’ বললে হাসির উদ্রেক হবে। অথচ ‘নাচুনে’ চলতে পারে। ‘দৌড়ুনে’ কথার দরকার আছে কিন্তু বলা হয় না, কেউ যদি সাহস করে বলে খুশি হব। ‘দ্রুতধাবনশীল ঘোড়া’র চেয়ে ‘জোরে-দৌড়ুনে ঘোড়া’ কানে ভালোই শোনায়। এই শব্দগুলোর প্রত্যয়টাকে ঠিক উনে বলা চলবে না; ‘নাচুনে’ শব্দের গোড়া হচ্ছে : নাচন + ইয়া = নাচনিয়া। বাংলা ভাষার প্রকৃতি ই এবং আ’কে উ এবং এ কার দিয়েছে, হয়ে উঠেছে ‘নাচুনে’। এই কথাটা মনে করে কৌতুক লাগে যে, দুটো অসদৃশ স্বরবর্ণকে ঠেলে দিয়ে কোথা থেকে উ এবং এ যায় জুটে।

সংস্কৃতে প্রত্যয় নিয়ম মেনে চলে, বাংলায় প্রায়ই ফাঁকি দেয়। বেসুর-বিশিষ্টকে বলি ‘বেসুরা’ (চলতি উচ্চারণ ‘বেসুরো’); সুর-বিশিষ্টকে বলি নে ‘সুরা’ বা ‘সুরো’, আর কী বলি তাও তো ভেবে পাই নে। ‘সুরেলা গলা’ হয়তো বলে থাকি জানি নে, অন্তত বলতে দোষ নেই। বালি-বিশিষ্টকে বলি ‘বালিয়া’, অপভ্রংশে ‘বেলে’; কিন্তু চিনি-বিশিষ্টকে বলব না ‘চিনিয়া’ বা ‘চিনে’, চিনদেশজ বাদামকে ‘চিনে বাদাম’ বলতে আপত্তি করি নে।

অনা প্রত্যয়-যোগে হয় ‘পাও’ থেকে ‘পাওনা’, ‘গাও’ থেকে ‘গাওনা’। কিন্তু ‘ধাও’ থেকে ‘ধাওনা’ হয় না। অন্য প্রত্যয় যোগে হতে পারে ‘ধাওয়াই’। ‘কুট’ থেকে হয় ‘কোটনা’; ‘ফুট’ থেকে ‘ফুটকি’, হয়, ‘ফোটনা’ হয় না। ‘বাঁটা থেকে ‘বাঁটনা’