অনুবাদ-চর্চা
ঘটনার প্রকৃত যোগ আছে। ‘তিনি পড়িয়া গেলেন এবং তাঁহার পায়ের উপর দিয়া গাড়ি চলিয়া গেল’, এখানে ‘এবং’ শব্দটা বেখাপ। এরূপ বেখাপ প্রয়োগ কেহ করেন না বা আমি করি না এমন কথা বলি না কিন্তু ইহা যে বেখাপ তাহার উদাহরণ গতবারের শান্তিনিকেতন পত্রে কিছু কিছু দিয়াছি। He has enemies and they are paid by the Government ইহার বাংলা, ‘তাঁর শত্রু আছে; তারা সরকারের বেতন খায়’। এখানে ‘এবং’ কথাটা অচল। তাহার কারণ, এখানে দুই ঘটনা দুইরূপ। ‘তাঁহার পুত্র আছে এবং কন্যা আছে।’ ‘তাঁহার গাড়ি আছে এবং ঘোড়া আছে।’ এ-সব জায়গায় ‘এবং’ জোরে আপন আসন দখল করে।

আশ্বিন-কার্তিকের সংখ্যার শান্তিনিকেতনে বলিয়াছিলাম যে ‘এবং’ শব্দ দিয়া যোজিত দুই বাক্যাংশের মধ্যে ক্রিয়াপদের রূপের মিল থাকা চাই। যেমন ‘সে দরিদ্র এবং সে মূর্খ’ ‘সে চরকা কাটে এবং ধান ভানে’—প্রথম বাক্যটির দুই অংশই অস্তিত্ববাচক, শেষের বাক্যটির দুই অংশই কর্তৃত্ববাচক। ‘সে দরিদ্র এবং সে ধান ভানিয়া খায়’ আমার মতে এটা খাঁটি নহে। আমরা এরূপ স্থলে ‘এবং’ ব্যবহারই করি না, বলি, ‘সে দরিদ্র, ধান ভানিয়া খায়’। অথচ ইংরেজিতে অনায়াসে বলা চলে, She is poor and lives on husking rice।

‘রাম ধনী এবং তার বাড়ি তিনতলা’ এরূপ প্রয়োগ আমরা সহজে করি না। আমরা বলি, ‘রাম ধনী, তার বাড়ি তিন তলা।’

‘যার জমি আছে এবং সেই জমি যে চাষ করে এমন গৃহস্থ এই গ্রামে নেই’—এরূপ বাক্য বাংলায় চলে। বস্তুত এখানে ‘এবং’ উহ্য রাখিলে চলেই না। পূর্বোক্ত বাক্যে ‘এমন’ শব্দটি তৎপূর্ববর্তী সমস্ত শব্দগুলিকে জমাট করিয়া দিয়াছে। এমন, কেমন? না, ‘যার-জমি-আছে-এবং-সেই-জমি-যে-নিজে-চাষ-করে’ সমস্তটাই গৃহস্থ শব্দের এক বিশেষণ পদ। কিন্তু ‘তিনি স্কুল মাস্টার এবং তাঁর একটি খোঁড়া কুকুর আছে’ বাংলায় এখানে ‘এবং’ খাটে না, তার কারণ এখানে দুই বাক্যাংশ পৃথক, তাহাদের মধ্যে রূপের ও ভাবের ঘনিষ্ঠতা নাই। আমরা বলি, ‘তিনি স্কুল মাস্টার, তাঁর একটি খোঁড়া কুকুর আছে।’ কিন্তু ইংরেজিতে বলা চলে, He is a school master and he has a lame dog।

সংস্কৃত ভাষায় যে-সব জায়গায় দ্বন্দ্ব সমাস খাটে, চলিত বাংলায় আমরা সেখানে যোজক শব্দ ব্যবহার করি না। আমরা বলি, ‘হাতি ঘোড়া লোক লশকর নিয়ে রাজা চলেছেন,’ ‘চৌকি টেবিল আলনা আলমারিতে ঘরটি ভরা।’ ইংরেজিতে উভয় স্থলেই একটা and না বসাইয়া চলে না। যথা The king marches with his elephants, horses and soldiers’, "The room is full of chairs, tables, clothes, racks and almirahs।’

বাংলায় আর-একটি নূতন আমদানি যোজক শব্দ ‘ও’। লিখিত বাংলায় পণ্ডিতেরা ইহাকে ‘and’ শব্দের প্রতিশব্দরূপে গায়ের জোরে চালাইয়া দিয়াছেন। কিন্তু মুখের ভাষায় কখনোই এরূপ ব্যবহার খাটে না। আমরা বলি ‘রাজা চলেছেন, তাঁর সৈন্যও চলেছে’। ‘রাজা চলিয়াছেন ও তাঁহার সৈন্যদল চলিয়াছে’ ইহা ফোর্ট উইলিয়মের গোরাদের আদেশে পণ্ডিতদের বানানো বাংলা। এখন ‘ও’ শব্দের এইরূপ বিকৃত ব্যবহার বাংলা লিখিত ভাষায় এমনি শিকড় গাড়িয়াছে যে তাহাকে উৎপাটিত করা আর চলিবে না। মাঝে হইতে খাঁটি বাংলা যোজক ‘আর’ শব্দকে পণ্ডিতেরা বিনা অপরাধে লিখিত বাংলা হইতে নির্বাসিত করিয়াছেন। আমরা মুখে বলিবার বেলা বলি ‘সে চলেছে, আর কুকুরটি পিছন পিছন চলেছে’ অথবা ‘সে চলেছে, তার কুকুরটিও পিছন পিছন চলেছে’ কিন্তু লিখিবার বেলা লিখি ‘সে চলিয়াছে ও (কিংবা এবং) তাহার কুকুরটি তাহার অনুসরণ করিতেছে।’ ‘আর’ শব্দটিকে কি আর-একবার তার স্বস্থানে ফিরাইয়া আনিবার সময় হয় নাই? একটা সুখের কথা এই যে, পণ্ডিতদের আশীর্বাদ সত্ত্বেও ‘এবং’ শব্দটা বাংলা কবিতার মধ্যে প্রবেশ করিবার পথ পায় নাই।