অনুবাদ-চর্চা
বুঝায়। নিষ্ঠা শব্দেও সেইরূপ। persistent শব্দের অর্থ, যাহা নিরন্তর লাগিয়াই আছে। ‘নির্বন্ধ’ শব্দটিতে সেই লাগিয়া থাকা অর্থ আছে; ‘দৃঢ়নির্বন্ধ’ কথাটা বড়ো বেশি অপরিচিত। এখানে কেবল মাত্র ‘নিত্য’ বিশেষণ যোগে ইংরেজি শব্দের ভাব স্পষ্ট হইতে পারে।

আমাদের আলোচ্য ইংরেজি প্যারাগ্রাফে একটি বাক্য আছে ‘among them are many species of birds’; আমাদের একজন ছাত্র এই species শব্দকে ‘উপজাতি’ প্রতিশব্দ দ্বারা তরজমা করিয়াছে। গতবারে ‘প্রতিশব্দ’ প্রবন্ধে আমরাই species-এর বাংলা ‘উপজাতি’ স্থির করিয়াছিলাম অথচ আমরাই এবারে কেন many ‘species of birds’ ‘নানাজাতীয় পক্ষী’ বলিলাম তাহার কৈফিয়ত আবশ্যক। মনে রাখিতে হইবে এখানে ইংরেজিতে species পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার করা হয় নাই। এখানে কোনো বিশেষ একটি মহাজাতীয় পক্ষীরই উপজাতিকে লক্ষ্য করিয়া speciesকথা বলা হয় নাই। বস্তুত কীটের যে-সব শত্রু আছে তাহারা নানা জাতিরই পক্ষী—কাকও হইতে পারে শালিকও হইতে পারে, শুধু কেবল কাক এবং দাঁড়কাক শালিক এবং গাঙশালিক নহে। বস্তুত সাধারণ ব্যবহারে অনেক শব্দ আপন মর্যাদা লঙ্ঘন করিয়া চলে, কেহ তাহাতে আপত্তি করে না, কিন্তু পারিভাষিক ব্যবহারে কঠোরভাবে নিয়ম মানিয়া চলিতে হয়। যেমন বন্ধুর নিমন্ত্রণক্ষেত্রে মানুষ নিয়মের দিকে দৃষ্টি রাখে না, সামাজিক নিমন্ত্রণে তাহাকে নিয়ম বাঁচাইয়া চলিতে হয়—এও সেইরূপ।

আমাদের তরজমায় আমরা অর্থ স্পষ্ট করিবার খাতিরে দুই-একটা বাড়তি শব্দ বসাইয়াছি। যেমন শেষ বাক্যে মূলে যেখানে আছে, ‘and among them are many species of birds’,আমরা লিখিয়াছি ‘এই শত্রুদের মধ্যে নানাজাতীয় পক্ষী আছে’—অবিকল অনুবাদ করিলে লিখিতে হইত ‘এবং তাহাদের মধ্যে ইত্যাদি’। ইংরেজিতে একটি সাধারণ নিয়ম এই যে, সর্বনাম শব্দ তাহার পূর্ববর্তী নিকটতম বিশেষ্য শব্দের সহিত সম্বন্ধবিশিষ্ট। এ স্থলে them সর্বনামের অনতিপূর্বেই আছে enemies, এইজন্য এখানে ‘তাহাদের’ বলিলেই শত্রুদের বুঝাইবে। বাংলায় এ নিয়ম পাকা নহে, এইজন্য, ‘তাহাদের মধ্যে নানাজাতীয় পক্ষী আছে’ বলিলে যদি কেহ হঠাৎ বুঝিয়া বসেন, ‘গাছেদের মধ্যে নানাজাতীয় পক্ষী আছে, অর্থাৎ পক্ষী বাসা বাঁধিয়া থাকে’ তবে তাঁহাকে খুব দোষী করা যাইবে না।

ইংরেজিতে ‘and’, আর বাংলায় ‘এবং’ শব্দের প্রয়োগ-ভেদ আছে। সেটা এখানে বলিয়া লই। ‘তাঁহার একদল নিন্দুক শত্রু আছে এবং তাহারা খবরের কাগজে তাঁহার নিন্দা করে’ এই বাক্যটা ইংরেজি ছাঁচের হইল। এ স্থলে আমরা ‘এবং’ ব্যবহার করি না। ‘তাঁহার একদল নিন্দুক শত্রু আছে এবং তাহারা সরকারের বেতনভোগী’। এখানেও ‘এবং’ বাংলায় চলে না। ‘তাঁহার একদল নিন্দুক শত্রু আছে এবং তিনি তাহাদিগকে গ্রাহ্য করেন না’ এরূপ স্থলে হয় ‘এবং’ বাদ দিই অথবা ‘কিন্তু’ বসাই। তাহার কারণ, ‘আছে’র সঙ্গে ‘আছে’, ‘করে’র সঙ্গে ক’রে, ‘হয়’-এর সঙ্গে ‘হয়’ মেলে, ‘আছে’র সঙ্গে ‘করে’, ‘করে’র সঙ্গে ‘হয়’ মেলে না। ‘তাঁহার শত্রু আছে এবং তাঁহার তিনটে মোটর গাড়ি আছে’—এই দুটি অসংশ্লিষ্ট সংবাদের মাঝখানেও ‘এবং’ চলে কিন্তু তাঁহার শত্রু আছে এবং তিনি শৌখিন লোক’ এরূপ স্থলে ‘এবং’ চলে না, কেননা ‘তাঁর আছে’ এবং ‘তিনি হন’ এ দুটো বাক্যের মধ্যে ভাষার গতি দুই দিকে। এগুলো যেন ভাষার অসবর্ণ বিবাহ, ইংরেজিতে চলে বাংলায় চলে না। ইংরেজির সঙ্গে বাংলার এই সূক্ষ্ম প্রভেদগুলি অনেক সময় অসতর্ক হইয়া আমরা ভুলিয়া যাই।

And শব্দযুক্ত ইংরেজি বাক্যে তরজমা করিতে গিয়া বার বার দেখিয়াছি তাহার অনেক স্থলেই বাংলায় ‘এবং’ শব্দ খাটে না। তখন আমার এই মনে হইয়াছে ‘এবং’ শব্দটা লিখিত বাংলায় পণ্ডিতদের কর্তৃক নূতন আমদানি, ইহার মানে ‘এইরূপ’। ‘আর’ শব্দ ‘অপর’ শব্দ হইতে উৎপন্ন, তাহার মানে ‘অন্যরূপ’। ‘তাঁহার ধন আছে এবং মান আছে’ বলিলে বুঝায় তাঁহার যেমন ধন আছে সেইরূপ মানও আছে। ‘তিনি প’ড়ে গেলেন, আর, একটা গাড়ি তাঁর পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল’—এখানে পড়িয়া যাওয়া একটা ঘটনা, অন্য ঘটনাটা অপর প্রকারের, সেইজন্য ‘আর’ শব্দটা খাটে। ‘তিনি পড়িয়া গেলেন এবং আঘাত পাইলেন’ এখানে দুইটি