কুমারসম্ভব ও শকুন্তলা

কালিদাস একান্তই সৌন্দর্যসম্ভোগের কবি, এ মত লোকের মধ্যে প্রচলিত। সেইজন্য লৌকিক গল্পে-গুজবে কালিদাসের চরিত্র কলঙ্কে মাখানো। এই গল্পগুলি জনসাধারণ-কর্তৃক কালিদাসের কাব্য সমালোচনা। ইহা হইতে বুঝা যাইবে, জনসাধারণের প্রতি আর যে কোনো বিষয়ে আস্থা স্থাপন করা যাক, সাহিত্যবিচার সম্বন্ধে সেই অন্ধের উপরে অন্ধ নির্ভর করা চলে না।

মহাভারতে যে-একটা বিপুল কর্মের আন্দোলন দেখা যায় তাহার মধ্যে একটি বৃহৎ বৈরাগ্য স্থির অনিমেষভাবে রহিয়াছে। মহাভারতের কর্মেই কর্মের চরম প্রাপ্তি নহে। তাহার সমস্ত শৌর্যবীর্য, রাগদ্বেষ, হিংসা-প্রতিহিংসা, প্রয়াস ও সিদ্ধির মাঝখানে শ্মশান হইতে মহাপ্রস্থানের ভৈরবসংগীত বাজিয়া উঠিতেছে। রামায়ণেও তাহাই; পরিপূর্ণ আয়োজন ব্যর্থ হইয়া যায়, করায়ত্ত সিদ্ধি স্খলিত হইয়া পড়ে—সকলেরই পরিণামে পরিত্যাগ। অথচ এই ত্যাগে দুঃখে নিস্ফলতাতেই কর্মের মহত্ত্ব ও পৌরুষের প্রভাব রজতগিরির ন্যায় উজ্জ্বল অভ্রভেদী হইয়া উঠিয়াছে।

সেইরূপ কালিদাসের সৌন্দর্যচাঞ্চল্যের মাঝখানে ভোগবৈরাগ্য স্তব্ধ হইয়া আছে। মহাভারতকে যেমন একই কালে কর্ম ও বৈরাগ্যের কাব্য বলা যায়, তেমনি কালিদাসকেও একই কালে সৌন্দর্যভোগের এবং ভোগবিরতির কবি বলা যাইতে পারে। তাঁহার কাব্য সৌন্দর্যবিলাসেই শেষ হইয়া যায় না; তাহাকে অতিক্রম করিয়া তবে কবি ক্ষান্ত হইয়াছেন।

কালিদাস কোথায় থামিয়াছেন এবং কোথায় থামেন নাই, সেইটে এখনকার আদর্শের সহিত তুলনা করিয়া আলোচনা করিবার বিষয়। পথের কোনো-একটা অংশে থামিয়া তাঁহাকে বিচার করা যায় না, তাঁহার গম্যস্থান কোথায় তাহা দেখিতে হইবে।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ধীবরের হাত হইতে আংটি পাইয়া যেখানে দুষ্মন্ত আপনার ভ্রম বুঝিতে পারিয়াছেন, সেইখানে ব্যর্থ পরিতাপের মধ্যে য়ুরোপীয় কবি শকুন্তলা নাটকের যবনিকা ফেলিতেন। শেষ অঙ্কে স্বর্গ হইতে ফিরিবার পথে দৈবক্রমে দুষ্মন্তের সহিত শকুন্তলার যে মিলন হইয়াছে তাহা য়ুরোপের নাট্যরীতি-অনুসারে অবশ্য ঘটনীয় নহে। কারণ, শকুন্তলা নাটকের আরম্ভে যে বীজবপন হইয়াছে এই বিচ্ছেদই তাহার চরম ফল। তাহার পরেও দুষ্মন্ত-শকুন্তলার পুনর্মিলন বাহ্য উপায়ে দৈবানুগ্রহে ঘটাইয়া তুলিতে হইয়াছে। নাটকের অন্তর্গত কোনো ঘটনাসূত্রে, দুষ্মন্ত-শকুন্তলার কোনো ব্যবহারে, এ মিলন ঘটিবার কোনো পথ ছিল না।

তেমনি, এখনকার কবি কুমারসম্ভবে হতমনোরথ পার্বতীর দুঃখ ও লজ্জার মধ্যে কাব্য শেষ করিতেন। অকালবসন্তে রক্তবর্ণ অশোককুঞ্জে মদনমথনের দীপ্ত দেবরোষাগ্নিচ্ছটায় নতমুখী লজ্জারুণা গিরিরাজকন্যা তাঁহার সমস্ত ব্যর্থ পুষ্পাভরণ বহিয়া পাঠকের ব্যথিত হৃদয়ের করুণ রক্তপদ্মের উপর আসিয়া দাঁড়াইতেন, অকৃতার্থ প্রেমের বেদনা তাঁহাকে চিরকালের জন্য ঘেরিয়া থাকিত। এখনকার সমালোচকের মতে এইখানেই কাব্যের উজ্জ্বলতম সূর্যাস্ত, তাহার পরে বিবাহের রাত্রি অত্যন্ত বর্ণচ্ছটাহীন।

বিবাহ প্রাত্যহিক সংসারের ভূমিকা; তাহা নিয়মবদ্ধ সমাজের অঙ্গ। বিবাহ এমন একটি পথ নির্দেশ করে যাহার লক্ষ্য একমাত্র ও সরল এবং যাহাতে প্রবল প্রবৃত্তি দস্যুতা করিতে প্রবল নিষেধ প্রাপ্ত হয়। সেইজন্য এখনকার কবিরা বিবাহব্যাপারকে তাঁহাদের কাব্যে বড়ো করিয়া দেখাইতে চান না। যে প্রেম উদ্দামবেগে নরনারীকে তাহার চারি দিকের সহস্র বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া দেয়, তাহাদিগকে সংসারের চিরকালের অভ্যস্ত পথ হইতে বাহির করিয়া লইয়া যায়, যে প্রেমের বলে নরনারী মনে করে তাহারা আপনাতেই আপনারা সম্পূর্ণ, মনে করে যে যদি সমস্ত সংসার বিমুখ হয় তবু তাহাদের ভয় নাই, অভাব নাই, যে প্রেমের উত্তেজনায় তাহারা ঘূর্ণবেগে বিচ্ছন্ন-বিক্ষিপ্ত গ্রহের মতো তাহাদের চারি দিক হইতে স্বতন্ত্র হইয়া নিজেদের মধ্যেই নিবিড় হইয়া উঠে, সেই প্রেমই প্রধানরূপে কাব্যের বিষয়।