রঙ্গমঞ্চ

ভরতের নাট্যশাস্ত্রে নাট্যমঞ্চর বর্ণনা আছে। তাহাতে দৃশ্যপটের কোনো উল্লেখ দেখিতে পাই না। তাহাতে যে বিশেষ ক্ষতি হইয়াছিল, এরূপ আমি বোধ করি না।

কলাবিদ্যা যেখানে একেশ্বরী সেইখানেই তাহার পূর্ণ গৌরব। সতিনের সঙ্গ ঘর করিতে গেলে তাহকে খাটো হইতেই হইবে। বিশেষত সতিন যদি প্রবল হয়। রামায়ণকে যদি সুর করিয়া পড়িতে হয় তবে আদিকাণ্ড হইতে উত্তরকান্ড পর্যন্ত সে সুরকে চিরকাল সমান একঘেয়ে হইয়া থাকিতে হয়, রাগিণী-হিসাবে সে বেচারার কোনোকাল পদোন্নতি ঘটে না। যাহা উচ্চদরের কাব্য তাহা আপনার সংগীত আপনার নিয়মেই জোগাইয়া থাকে, বাহিরের সংগীতের সাহায্য অবজ্ঞার সঙ্গ উপেক্ষা করে। যাহা উচ্চ-অঙ্গের সংগীত তাহা আপনার কথা আপনার নিয়মেই বলে, তাহা কথার জন্য কালিদাস-মিলটনের মুখাপেক্ষা করে না–তাহা নিতান্ত তুচ্ছ তোম-তানা-নানা লইয়াই চমৎকার কাজ চালাইয়া দেয়। ছবিতে গানেতে কথায় মিশাইয়া ললিতকলার একটা বারোয়ারি ব্যাপার করা যাইতে পারে, কিন্তু সে কতকটা খেলা-হিসাবে; তাহা হাটের জিনিস, তাহাকে রাজকীয় উৎসবের উচ্চ আসন দেওয়া যাইতে পারে না।

কিন্তু শ্রাব্যকাব্যের চেয়ে দৃশ্যকাব্য স্বভাবতই কতকটা পরাধীন বটে। বাহিরের সাহায্যেই নিজেকে সার্থক করিবার জন্য সে বিশেষভাবে সৃষ্ট। সে যে অভিনয়ের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে, এ কথা তাহাকে স্বীকার করিতেই হয়।

আমরা এ কথা স্বীকার করি না। সাধ্বী স্ত্রী যেমন স্বামীকে ছাড়া আর-কাহাকেও চায় না, ভালো কাব্য তেমনি ভাবুক ছাড়া আর-কাহারো অপেক্ষা করে না। সাহিত্য পাঠ করিবার সময় আমরা সকলেই মনে মনে অভিনয় করিয়া থাকি; সে অভিনয়ে যে কাব্যের সৌন্দর্য্য খোলে না সে কাব্য কোনো কবিকে যশস্বী করে নাই।

বরঞ্চ এ কথা বলিতে পারো যে, অভিনয়বিদ্যা নিতান্ত পরাশ্রিতা। সে অনাথা নাটকের জন্য পথ চাহিয়া বসিয়া থাকে। নাটকের গৌরব অবলম্বন করিয়াই সে আপনার গৌরব দেখাইতে পারে।

স্ত্রৈণ স্বামী যেমন লোকের কাছে উপহাস পায়, নাটক তেমনি যদি অভিনয়ের অপেক্ষা করিয়া আপনাকে নানা দিকে খর্ব করে তবে সে-ও সেইরূপ উপহাসের যোগ্য হইয়া উঠে। নাটকের ভাবখানা এইরূপ হওয়া উচিৎ যে, ‘আমার যদি অভিনয় হয় তো হউক, না হয় তো অভিনয়ের পোড়াকপাল–আমার কোনোই ক্ষতি নাই। '

যাহাই হউক, অভিনয়কে কাব্যের অধীনতা স্বীকার করিতেই হয়। কিন্তু তাই বলিয়া সকল কলাবিদ্যারই গোলামি তাহাকে করিতে হইবে এমন কী কথা আছে। যদি সে আপনার গৌরব রাখিতে চায় তবে যেটুকু অধীনতা তাহার আত্মপ্রকাশের জন্য নিতান্তই না হইলে নয় সেইটুকুই সে যেন গ্রহণ করে; তাহার বেশি সে যাহা-কিছু অবলম্বন করে তাহাতে তাহার নিজের অবমাননা হয়।

ইহা বলা বাহুল্য, নাট্যোক্ত কথাগুলি অভিনেতার পক্ষে নিতান্ত আবশ্যক। কবি তাহাকে যে হাসির কথাটি জোগান তাহা লইয়াই তাহাকে হাসিতে হয়; কবি তাহাকে যে কান্নার অবসর দেন তাহা লইয়াই কাঁদিয়া সে দর্শকের চোখে জল টানিয়া আনে। কিন্তু ছবিটা কেন? তাহা অভিনেতার পশ্চাতে ঝুলিতে থাকে, অভিনেতা তাহাকে সৃষ্টি করিয়া তোলে না; তাহা আঁকামাত্র; আমার মতে তাহাতে অভিনেতার অক্ষমতা, কাপুরুষতা প্রকাশ পায়। এইরূপে যে উপায়ে দর্শকদের মনে বিভ্রম উৎপাদন করিয়া সে নিজের কাজকে সহজ করিয়া তোলে তাহা চিত্রকরের কাছ হইতে ভিক্ষা করিয়া আনা।

তা ছাড়া, যে দর্শক তোমার অভিনয় দেখিতে আসিয়াছে তাহার কি নিজের সম্বল কানা-কড়াও নাই? সে কি শিশু? বিশ্বাস