ভদ্রতার আদর্শ
জড়ত্ব, উহা অহংকারের বিষয় নহে।

ক্ষিতি কহিল–আমাদের এই মূর্ছাবস্থাকে আমরা আধ্যাত্মিক ‘দশা’পাওয়ার অবস্থা মনে করিয়া নিজের প্রতি নিজে ভক্তিতে বিহ্বল হইয়া বসিয়া আছি।

ব্যোম কহিল–কর্মীকে কর্মের কঠিন নিয়ম মানিয়া চলিতে হয়, সেইজন্যই সে আপন কর্মের নিয়মপালন উপলক্ষ্যে সমাজের অনেক ছোটো কর্তব্য উপেক্ষা করিতে পারে–কিন্তু অকর্মণ্যের সে অধিকার থাকিতে পারে না। যে লোক তাড়াতাড়ি আপিসে বাহির হইতেছে তাহার নিকটে সমাজ সুদীর্ঘ সুসম্পূর্ণ শিষ্টালাপ প্রত্যাশা করে না। ইংরাজ মালী যখন গায়ের কোর্তা খুলিয়া হাতের আস্তিন গুটাইয়া বাগানের কাজ করে তখন তাহাকে দেখিয়া তাহার অভিজাতবংশীয়া প্রভুমহিলার লজ্জা পাইবার কোনো কারণ নাই। কিন্তু আমরা যখন কোনো কাজ নাই, কর্ম নাই, দীর্ঘ দিন রাজপথপার্শ্বে নিজের গৃহদ্বারপ্রান্তে স্থূল বর্‌তুল উদর উদ্‌ঘাটিত করিয়া, হাঁটুর উপর কাপড় গুটাইয়া, নির্বোধের মতো তামাক টানি, তখন বিশ্বজগতের সম্মুখে কোন্‌ মহৎ বৈরাগ্যের কোন্‌ উন্নত আধ্যাত্মিকতার দোহাই দিয়া এই কুশ্রী বর্বরতা প্রকাশ করিয়া থাকি! যে বৈরাগ্যের সঙ্গে কোনো মহত্তর সচেষ্ট সাধনা সংযুক্ত নাই তাহা অসভ্যতার নামান্তর মাত্র। ব্যোমের মুখে এই-সকল কথা শুনিয়া স্রোতস্বিনী আশ্চর্য হইয়া গেল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল–আমরা সকল ভদ্রলোকেই যত দিন না আপন ভদ্রতা রক্ষার কর্তব্য সর্বদা মনে রাখিয়া আপনাদিগকে বেশে ব্যবহারে বাসস্থানে সর্বতোভাবে ভদ্র করিয়া রাখিবার চেষ্টা করিব তত দিন আমরা আত্মসম্মান লাভ করিব না এবং পরের নিকট সম্মান প্রাপ্ত হইব না। আমরা নিজের মূল্য নিজে অত্যন্ত কমাইয়া দিয়াছি।

ক্ষিতি কহিল–সে মূল্য বাড়াইতে হইলে এ দিকে বেতনবৃদ্ধি করিতে হয়, সেটা প্রভুদের হাতে।

দীপ্তি কহিল–বেতনবৃদ্ধি নহে চেতনবৃদ্ধির আবশ্যক। আমাদের দেশের ধনীরাও যে অশোভন ভাবে থাকে সেটা কেবল জড়তা এবং মূঢ়তা-বশত, অর্থের অভাবে নহে। যাহার টাকা আছে সে মনে করে জুড়িগাড়ি না হইলে তাহার ঐশ্বর্য প্রমাণ হয় না, কিন্তু তাহার অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলে দেখা যায় যে, তাহা ভদ্রলোকের গোশালারও অযোগ্য। অহংকারের পক্ষে যে আয়োজন আবশ্যক তাহার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আছে, কিন্তু আত্মসম্মানের জন্য, স্বাস্থ্যশোভার জন্য যাহা আবশ্যক তাহার বেলায় আমাদের টাকা কুলায় না। আমাদের মেয়েরা এ কথা মনেও করে না যে, সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্য যতটুকু অলংকার আবশ্যক তাহার অধিক পরিয়া ধনগর্ব প্রকাশ করিতে যাওয়া ইতরজনোচিত অভদ্রতা–এবং সেই অহংকারতৃপ্তির জন্য টাকার অভাব হয় না, কিন্তু প্রাঙ্গণপূর্ণ আবর্জনা এবং শয়নগৃহভিত্তির তৈলকজ্জলময় মলিনতা-মোচনের জন্য তাহাদের কিছু মাত্র সত্বরতা নাই। টাকার অভাব নহে, আমাদের দেশে যথার্থ ভদ্রতার আদর্শ এখনো প্রতিষ্ঠিত হয় নাই।

স্রোতস্বিনী কহিল–তাহার প্রধান কারণ, আমরা অলস। টাকা থাকিলেই বড়োমানুষি করা যায়, টাকা না থাকিলেও ধার করিয়া নবাবি করা চলে, কিন্তু ভদ্র হইতে গেলে আলস্য-অবহেলা বিসর্জন করিতে হয়, সর্বদা আপনাকে উন্নত সামাজিক আদর্শের উপযোগী করিয়া প্রস্তুত রাখিতে হয়, নিয়ম স্বীকার করিয়া আত্মবিসর্জন করিতে হয়।

ক্ষিতি কহিল–কিন্তু আমরা মনে করি আমরা স্বভাবের শিশু, অতএব অত্যন্ত সরল। ধুলায় কাদায় নগ্নতায়, সর্বপ্রকার নিয়মহীনতায় আমাদের কোনো লজ্জা নাই–আমাদের সকলই অকৃত্রিম এবং সকলই আধ্যাত্মিক।