ভদ্রতার আদর্শ
হইতেছে। আমরা বলিয়া থাকি আমাদের সভ্যতা আধ্যাত্মিক সভ্যতা, অশনবসনগত সভ্যতা নহে, সেইজন্যই এই-সকল জড় বিষয়ে আমাদের এত অনাসক্তি।

সমীর কহিল–উচ্চতম বিষয়ে সর্বদা লক্ষ স্থির রাখাতে নিম্নতন বিষয়ে যাঁহাদের বিস্মৃতি ও ঔদাসীন্য জন্মে তাঁহাদের সম্বন্ধে নিন্দার কথা কাহারও মনেও আসে না। সকল সভ্যসমাজেই এরূপ এক সম্প্রদায়ের লোক সমাজের বিরল উচ্চশিখরে বাস করিয়া থাকেন। অতীত ভারতবর্ষে অধ্যয়ন-অধ্যাপন-শীল ব্রাহ্মণ এই-শ্রেণী-ভুক্ত ছিলেন; তাঁহারা যে ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের ন্যায় সাজসজ্জা ও কাজকর্মে নিরত থাকিবেন এমন কেহ আশা করিত না। য়ুরোপেও সে সম্প্রদায়ের লোক ছিল এবং এখনো আছে। মধ্যযুগের আচার্যদের কথা ছাড়িয়া দেওয়া যাক, আধুনিক য়ুরোপেও নিউটনের মতো লোক যদি নিতান্ত হাল ফ্যাশানের সান্ধ্যবেশ না পারিয়াও নিমন্ত্রণে যান এবং লৌকিকতার সমস্ত নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন না করেন, তথাপি সমাজ তাঁহাকে শাসন করে না, উপহাস করিতেও সাহস করে না। সর্বদেশে সর্বকালেই স্বল্পসংখ্যক মহাত্মা লোকসমাজের মধ্যে থাকিয়াও সমাজের বাহিরে থাকেন, নতুবা তাঁহারা কাজ করিতে পারেন না এবং সমাজও তাঁহাদের নিকট হইতে সামাজিকতার ক্ষুদ্র শুল্কগুলি আদায় করিতে নিরস্ত থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে বাংলাদেশে, কেবল কতকগুলি লোক নহে, আমরা দেশসুদ্ধ সকলেই সকল-প্রকার স্বভাববৈচিত্র্য ভুলিয়া সেই সমাজাতীত আধ্যাত্মিক শিখরে অবহেলে চড়িয়া বসিয়া আছি। আমরা ঢিলা কাপড় এবং অত্যন্ত ঢিলা আদব-কায়দা লইয়া দিব্য আরামে ছুটি ভোগ করিতেছি–আমরা যেমন করিয়াই থাকি আর যেমন করিয়াই চলি তাহাতে কাহারও সমালোচনা করিবার কোনো অধিকার নাই–কারণ, আমরা উত্তম মধ্যম অধম সকলেই খাটো ধুতি ও ময়লা চাদর পরিয়া নির্‌গুণ ব্রহ্মে লয় পাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া বসিয়া আছি।

হেনকালে ব্যোম তাহার বৃহৎ লগুড়খানি হাতে করিয়া আসিয়া উপস্থিত। তাহার বেশ অন্য দিনের অপেক্ষাও অদ্ভুত; তাহার কারণ, আজ ক্রিয়াকর্মের বাড়ি বলিয়াই তাহার প্রাত্যহিক বেশের উপরে বিশেষ করিয়া একখানা অনির্দিষ্ট-আকৃতি চাপকান গোছের পদার্থ চাপাইয়া আসিয়াছে; তাহার আশপাশ হইতে ভিতরকার অসংগত কাপড়গুলার প্রান্ত স্পষ্ট দেখা যাইতেছে–দেখিয়া আমাদের হাস্য সম্বরণ করা দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল এবং দীপ্তি ও স্রোতস্বিনীর মনে যথেষ্ট অবজ্ঞার উদয় হইল।

ব্যোম জিজ্ঞাসা করিল–তোমাদের কী বিষয়ে আলাপ হইতেছে? সমীর আমাদের আলোচনার কিয়দংশ সংক্ষেপে বলিয়া কহিল–আমরা দেশসুদ্ধ সকলেই বৈরাগ্যের “ভেক” ধারণ করিয়াছি।

ব্যোম কহিল–বৈরাগ্য ব্যতীত কোনো বৃহৎ কর্ম হইতেই পারে না। আলোকের সহিত যেমন ছায়া, কর্মের সহিত তেমনি বৈরাগ্য নিয়ত সংযুক্ত হইয়া আছে। যাহার যে পরিমাণে বৈরাগ্যে অধিকার পৃথিবীতে সে সেই পরিমাণে কাজ করিতে পারে।

ক্ষিতি কহিল–সেইজন্য পৃথিবীসুদ্ধ লোক যখন সুখের প্রত্যাশায় সহস্র চেষ্টায় নিযুক্ত ছিল তখন বৈরাগী ডারুয়িন সংসারের সহস্র চেষ্টা পরিত্যাগ করিয়া কেবল প্রমাণ করিতেছিলেন যে, মানুষের আদিপুরুষ বানর ছিল। এই সমাচারটি আহরণ করিতে ডারুয়িনকে অনেক বৈরাগ্য সাধন করিতে হইয়াছিল।

ব্যোম কহিল–বহুতর আসক্তি হইতে গারিবাল্ডি যদি আপনাকে স্বাধীন করিতে না পারিতেন তবে ইটালিকেও তিনি স্বাধীন করিতে পারিতেন না। যে-সকল জাতি কনিষ্ঠ জাতি তাহারাই যথার্থ বৈরাগ্য জানে। যাহারা জ্ঞানলাভের জন্য জীবন ও জীবনের সমস্ত আরাম তুচ্ছ করিয়া মেরুপ্রদেশের হিমশীতল মৃত্যুশালার তুষাররুদ্ধ কঠিন দ্বারদেশে বারম্বার আঘাত করিতে ধাবিত হইতেছে, যাহারা ধর্মবিতরণের জন্য নরমাংসভুক্ রাক্ষসের দেশে চিরনির্বাসন বহন করিতেছে, যাহারা মাতৃভূমির আহ্বানে মুহূর্তকালের মধ্যেই ধনজনযৌবনের সুখশয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়া দুঃসহ ক্লেশ এবং অতি নিষ্ঠুর মৃত্যুর মধ্যে ঝাঁপ দিয়া পড়ে, তাহারাই জানে যথার্থ বৈরাগ্য কাহাকে বলে। আর আমাদের এই কর্মহীন শ্রীহীন নিশ্চেষ্ট নির্জীব বৈরাগ্য কেবল অধ:পতিত জাতির মূর্ছাবস্থামাত্র–উহা