প্রাঞ্জলতা

স্রোতস্বিনী কোনো-এক বিখ্যাত ইংরাজ কবির উল্লেখ করিয়া বলিলেন–কে জানে, তাঁহার রচনা আমার আছে ভালো লাগে না।

দীপ্তি আরও প্রবলতরভাবে স্রোতস্বিনীর মত সমর্থন করিলেন।

সমীর কখনো পারতপক্ষে মেয়েদের কোনো কথার স্পষ্ট প্রতিবাদ করে না। তাই সে একটু হাসিয়া ইতস্তত করিয়া কহিল–কিন্তু অনেক বড়ো বড়ো সমালোচক তাঁহাকে খুব উচ্চ আসন দিয়া থাকেন।

দীপ্তি কহিলেন–আগুন যে পোড়ায় তাহা ভালো করিয়া বুঝিবার জন্য কোনো সমালোচকের সাহায্য আবশ্যক করে না, তাহা নিজের বাম হস্তের কড়ে আঙুলের ডগার দ্বারাও বোঝা যায়; ভালো কবিতার ভালোত্ব যদি তেমনি অবহেলে না বুঝিতে পারি তবে আমি তাহার সমালোচনা পড়া আবশ্যক বোধ করি না।

আগুনের যে পোড়াইবার ক্ষমতা আছে সমীর তাহা জানিত, এইজন্য সে চুপ করিয়া রহিল; কিন্তু ব্যোম বেচারার সে-সকল বিষয়ে কোনোরূপ কাণ্ডজ্ঞান ছিল না, এই জন্য সে উচ্চস্বরে আপন স্বগত-উক্তি আরম্ভ করিয়া দিল।

সে বলিল–মানুষের মন মানুষকে ছাড়াইয়া চলে, অনেক সময় তাহাকে নাগাল পাওয়া যায় না–

ক্ষিতি তাহাকে বাধা দিয়া কহিল–ত্রেতাযুগে হনুমানের শতযোজন লাঙ্গুল শ্রীমান হনুমানজিউকে ছাড়াইয়া বহু দূরে গিয়া পৌঁছিত; লাঙ্গুলের ডগাটুকুতে যদি উকুন বসিত তবে তাহা চুলকাইয়া আসিবার জন্য ঘোড়ার ডাক বসাইতে হইত। মানুষের মন হনুমানের লাঙ্গুলের অপেক্ষাও সুদীর্ঘ, সেইজন্য এক-এক সময়ে মন যেখানে গিয়া পৌঁছায়, সমালোচকের ঘোড়ার ডাক ব্যতীত সেখানে হাত পৌঁছে না। লেজের সঙ্গে মনের প্রভেদ এই যে, মনটা আগে আগে চলে এবং লেজটা পশ্চাতে পড়িয়া থাকে। এইজন্যই জগতে লেজের এত লাঞ্ছনা এবং মনের এত মাহাত্ম্য।

ক্ষিতির কথা শেষ হইলে ব্যোম পুনশ্চ আরম্ভ করিল–বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য জানা, এবং দর্শনের উদ্দেশ্য বোঝা, কিন্তু কাণ্ডটি এমনি হইয়া দাঁড়াইয়াছে যে, বিজ্ঞানটি জানা এবং দর্শনটি বোঝাই অন্য সকল জানা এবং অন্য সকল বোঝার অপেক্ষা শক্ত হইয়া উঠিয়াছে। ইহার জন্য কত ইস্কুল, কত কেতাব, কত আয়োজন আবশ্যক হইয়াছে! সাহিত্যের উদ্দেশ্য আনন্দ দান করা, কিন্তু সে আনন্দটি গ্রহণ করাও নিতান্ত সহজ নহে; তাহার জন্যও বিবিধ প্রকার শিক্ষা এবং সাহায্যের প্রয়োজন। সেইজন্যই বলিতেছিলাম, দেখিতে দেখিতে মন এতটা অগ্রসর হইয়া যায় যে, তাহার নাগাল পাইবার জন্য সিঁড়ি লাগাইতে হয়। যদি কেহ অভিমান করিয়া বলেন, যাহা বিনা শিক্ষায় না জানা যায় তাহা বিজ্ঞান নহে, যাহা বিনা চেষ্টায় না বোঝা যায় তাহা দর্শন নহে এবং যাহা বিনা সাধনায় আনন্দ দান না করে তাহা সাহিত্য নহে, তবে কেবল খনার বচন, প্রবাদবাক্য এবং পাঁচালি অবলম্বন করিয়া তাঁহাকে অনেক পশ্চাতে পড়িয়া থাকিতে হইবে।

সমীর কহিল–মানুষের হাতে সব জিনিসই ক্রমশ কঠিন হইয়া উঠে। অসভ্যেরা যেমন-তেমন চীৎকার করিয়াই উত্তেজনা অনুভব করে, অথচ আমাদের এমনি গ্রহ যে বিশেষ অভ্যাসসাধ্য শিক্ষাসাধ্য সংগীত ব্যতীত আমাদের সুখ নাই, আরও গ্রহ এই যে ভালো গান করাও যেমন শিক্ষাসাধ্য ভালো গান হইতে সুখ অনুভব করাও তেমনি শিক্ষাসাধ্য। তাহার ফল হয় এই যে, এক সময়ে যাহা সাধারণের ছিল, ক্রমেই তাহা সাধকের হইয়া আসে। চীৎকার সকলেই করিতে পারে এবং চীৎকার করিয়া অসভ্য সাধারণে সকলেই উত্তেজনাসুখ অনুভব করে, কিন্তু গান সকলে করিতে পারে না এবং গানে সকলে সুখও পায় না। কাজেই সমাজ যতই