অখণ্ডতা

দীপ্তি কহিল–সত্য কথা বলিতেছি, আমার তো মনে হয় আজকাল প্রকৃতির স্তব লইয়া তোমরা সকলে কিছু বাড়াবাড়ি আরম্ভ করিয়াছ।

আমি কহিলাম–দেবী, আর-কাহারও স্তব বুঝি তোমাদের গায়ে সহে না?

দীপ্তি কহিল–যখন স্তব ছাড়া আর বেশি কিছু পাওয়া যায় না তখন ওটার অপব্যয় দেখিতে পারি না।

সমীর অত্যন্ত বিনম্রমনোহর হাস্যে গ্রীবা আনমিত করিয়া কহিল–ভগবতী, প্রকৃতির স্তব এবং তোমাদের স্তবে বড়ো-একটা প্রভেদ নাই। ইহা বোধ হয় লক্ষ্য করিয়া দেখিয়া থাকিবে, যাহারা প্রকৃতির স্তবগান রচনা করিয়া থাকে তাহারা তোমাদেরই মন্দিরের প্রধান পূজারি।

দীপ্তি অভিমানভরে কহিল–অর্থাৎ যাহারা জড়ের উপাসনা করে তাহারাই আমাদের ভক্ত। সমীর কহিল–এতবড়ো ভুলটা বুঝিলে, কাজেই একটা সুদীর্ঘ কৈফিয়ত দিতে হয়। আমাদের ভূতসভার বর্তমান সভাপতি শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত ভূতনাথ বাবু তাঁর ডায়ারিতে মন-নামক একটা দুরন্ত পদার্থের উপদ্রবের কথা বর্ণনা করিয়া যে-একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছেন, সে তোমরা সকলেই পাঠ করিয়াছ। আমি তাহার নীচেই গুটিকতক কথা লিখিয়া রাখিয়াছি, যদি সভ্যগণ অনুমতি করেন তবে পাঠ করি–আমার মনের ভাবটা তাহাতে পরিষ্কার হইবে।

ক্ষিতি করজোড়ে কহিল–দেখো ভাই সমীরণ, লেখক এবং পাঠকে যে সম্পর্ক সেইটেই স্বাভাবিক সম্পর্ক–তুমি ইচ্ছা করিয়া লিখিলে, আমি ইচ্ছা করিয়া পড়িলাম, কোনো পক্ষে কিছু বলিবার রহিল না। যেন খাপের সহিত তরবারি মিলিয়া গেল। কিন্তু তরবারি যদি অনিচ্ছুক অস্থিচর্মের মধ্যে সেই-প্রকার সুগভীর আত্মীয়তা স্থাপনে প্রবৃত্ত হয় তবে সেটা তেমন বেশ স্বাভাবিক এবং মনোহররূপে সম্পন্ন হয় না। লেখক এবং শ্রোতার সম্পর্কটাও সেইরূপ অস্বাভাবিক, অসদৃশ। হে চতুরানন, পাপের যেমন শাস্তিই বিধান কর যেন আর-জন্মে ডাক্তারের ঘোড়া, মাতালের স্ত্রী এবং প্রবন্ধলেখকের বন্ধু হইয়া জন্মগ্রহণ না করি।

ব্যোম একটা পরিহাস করিতে চেষ্টা করিল, কহিল–একে তো বন্ধু অর্থেই বন্ধন, তাহার উপরে প্রবন্ধবন্ধন হইলে ফাঁসের উপরে ফাঁস হয়; গণ্ডস্যোপরি বিস্ফোটকম্‌।

দীপ্তি কহিল–হাসিবার জন্য দুইটি বৎসর সময় প্রার্থনা করি; ইতিমধ্যে পাণিনি অমরকোষ এবং ধাতুপাঠ আয়ত্ত করিয়া লইতে হইবে। শুনিয়া ব্যোম অত্যন্ত কৌতুকলাভ করিল। হাসিতে হাসিতে কহিল–বড়ো চমৎকার বলিয়াছ; আমার একটা গল্প মনে পড়িতেছে–

স্রোতস্বিনী কহিল–তোমরা সমীরের লেখাটা আজ আর শুনিতে দিবে না দেখিতেছি। সমীর, তুমি পড়ো, উহাদের কথায় কর্ণপাত করিয়ো না। স্রোতস্বিনীর আদেশের বিরুদ্ধে কেহ আর আপত্তি করিল না। এমন-কি, স্বয়ং ক্ষিতি শেল্‌ফের উপর হইতে ডায়ারির খাতাটি পাড়িয়া আনিল এবং নিতান্ত নিরীহ নিরুপায়ের মতো সংযত হইয়া বসিয়া রহিল।

সমীর পড়িতে লাগিল–মানুষকে বাধ্য হইয়া পদে পদে মনের সাহায্য লইতে হয়, এইজন্য ভিতরে ভিতরে আমরা সেটাকে দেখিতে পারি না। মন আমাদের অনেক উপকার করে, কিন্তু তাহার স্বভাব এমনই যে, আমাদের সঙ্গে কিছুতেই সে সম্পূর্ণ মিলিয়া মিশিয়া থাকিতে পারে না। সর্বদা খিট্‌খিট্‌ করে, পরামর্শ দেয়, উপদেশ দিতে আসে, সকল কাজেই হস্তক্ষেপ করে। সে যেন একজন বাহিরের লোক ঘরের হইয়া পড়িয়াছে–তাহাকে ত্যাগ করাও কঠিন, তাহাকে ভালোবাসাও দুঃসাধ্য।