জুবেয়ার

রসজ্ঞ ম্যাথ্যু আর্নলড্‌ ফরাসি ভাবুক জুবেয়ারের সহিত ইংরাজি-পাঠকদের পরিচয় করাইয়া দেন।

যখন যাহা মনে আসিত জুবেয়ার তাহা লিখিতেন কিন্তু প্রকাশ করিতেন না। তাঁহার রচনা প্রবন্ধরচনা নহে, এক-একটি ভাবকে স্বতন্ত্ররূপে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখা। পদ্যে যেমন সনেট, যেমন শ্লোক, গদ্যে এই লেখাগুলি তেমনি।

জুবেয়ারের বাক্সে দেরাজে এই লেখা কাগজসকল স্তূপাকার হইয়া ছিল; তাঁহার মৃত্যুর চোদ্দ বৎসর পরে এগুলি ছাপা হয়; তাহাও পাঠকসাধারণের জন্য নহে, কেবল বাছা বাছা অল্প গুটিকয়েক সমজদারের জন্য।

জুবেয়ার নিজের রচনার সম্বন্ধে লিখিয়াছেন–

‘আমি কেবল বপন করি, নির্মাণ বা পত্তন করি না।’

অর্থাৎ তিনি ভাবগুলিকে পরস্পর গাঁথিয়া কিছু-একটা বানাইয়া তোলেন না,সজীব ভাবের বীজকে এক-একটি করিয়া বপন করেন।

কোনো কোনো মনস্বী আপনার মনটিকে ফলের বাগান করিয়া রাখেন, তাঁহারা বিশেষ বিশেষ চিন্তা ও চর্চার দ্বারা চিত্তকে আবৃত করেন, চতুর্দিকের নিত্যবীজবর্ষণ তাঁহাদের মনের মধ্যে অনাহূত ও অবারিতভাবে স্থান পায় না।

জুবেয়ারের মন সে শ্রেণীর ছিল না, তাঁহার চিত্ত ফলের বাগান নহে, ফসলের ক্ষেত্র।

সে ফসল নানাবিধ। ধর্ম কর্ম কলারস সাহিত্য কত কী তাহার ঠিক নাই।

অদ্য আমরা সাহিত্য ও রচনাকলা সম্বন্ধে এক অঞ্জলি সংগ্রহ করিয়া পাঠকগণকে উপহার দিতে ইচ্ছা করি।–

জুবেয়ার নিজের সম্বন্ধে বলেন –

‘যাহা জানিবার ইচ্ছা ছিল তাহা শিক্ষা করিতে বৃদ্ধবয়সের প্রয়োজন হইল, কিন্তু যাহা জানিয়াছি তাহা ভালোরূপে প্রকাশ করিতে যৌবনের প্রয়োজন অনুভব করি।’

অর্থাৎ জ্ঞানের জন্য চেষ্টাজাত অভিজ্ঞতা চাই কিন্তু প্রকাশের জন্য নবীনতা আবশ্যক। লেখার বিষয়টির মধ্যে চিন্তার পরিচয় যত থাকে ততই তাহার গৌরব বাড়ে কিন্তু রচনার মধ্যে চেষ্টার লক্ষণ যত অল্প থাকিবে তাহার প্রকাশশক্তি ততই অধিক হইবে।

জুবেয়ার নিজে যে রচনাকলা অবলম্বন করিয়াছিলেন সে সম্বন্ধে বলিতেছেন,

‘তোমরা কথার ধ্বনির দ্বারা যে ফল পাইতে চাও আমি কথার অর্থ-দ্বারা সেই ফল ইচ্ছা করি; তোমরা কথার প্রাচুর্যের দ্বারা যাহা চাও আমি কথা নির্বাচনের দ্বারা তাহা চাই, তোমরা কথার সংগতির দ্বারা যাহা চাও আমি কথার পৃথক্‌করণের দ্বারা তাহা লাভ করিতে প্রয়াসী। অথচ সংগতিও (harmony) ইচ্ছা করি কিন্তু তাহা স্বভাবসিদ্ধ যথাযোগ্য সংগতি; জোড়া-বাঁধার নৈপুণ্যমাত্রের দ্বারা যে সংগতি রচিত তাহা চাই না।’

বস্তুত প্রতিভাসম্পন্ন লেখক ও লিপিকুশল লেখকের প্রভেদ এই যে, একজনের রচনায় সংগতি এমন স্বাভাবিক এবং অখণ্ড যে, তাহা বিশ্লেষণ করাই শক্ত, অপরের রচনায় সংগতি ইঁটের উপর ইঁটের ন্যায় গাঁথা ও সাজানো। প্রথমটি অজ্ঞাতসারে মুগ্ধ করে, দ্বিতীয়টি বিন্যাসনৈপুণ্যে বাহবা বলায়।

তর্কযুদ্ধ সম্বন্ধে জুবেয়ার বলেন –

‘তর্কবিতর্কের প্রয়োজনীয়তা যতটুকু তাহার ঝঞ্ঝাট তদপেক্ষা অনেক বেশি। বিরোধমাত্রেই চিত্তকে বধির করিয়া ফেলে।