সৌন্দর্য ও সাহিত্য
বিশেষ কারণ আছে। ভাষায় এমন একটু কৌতুকরস লইয়া সে জাগিয়া উঠিয়াছে যে, সে শুধু কালকেতুর সভায় নয়, আমাদেরও হৃদয়ের দরবারে অনায়াসে স্থান পাইয়াছে। ভাঁড়ুদত্ত প্রত্যক্ষসংসারে ঠিক এমন করিয়া আমাদের গোচর হইত না। আমাদের মনের কাছে সুসহ করিবার পক্ষে ভাঁড়ুদত্তের যতটুকু আবশ্যক কবি তাহার চেয়ে বেশি কিছুই দেন নাই। কিন্তু প্রত্যক্ষসংসারের ভাঁড়ুদত্ত ঠিক ঐটুকুমাত্র নয়; এইজন্যই সে আমাদের কাছে অমন করিয়া গোচর হইবার অবকাশ পায় না। কোনো-একটা সমগ্রভাবে সে আমাদের কাছে গোচর হয় না বলিয়াই আমরা তাহাতে আনন্দ পাই না। কবিকঙ্কণ-চণ্ডীতে ভাঁড়ুদত্ত তাহার সমস্ত অনাবশ্যক বাহুল্য বর্জন করিয়া কেবল একটি সমগ্ররসের মূর্তিতে আমাদের কাছে প্রকাশ পাইয়াছে।

ভাঁড়ুদত্ত যেমন, চরিত্রমাত্রই সেইরূপ। রামায়ণের রাম যে কেবল মহান বলিয়াই আমাদিগকে আনন্দ দিতেছেন তাহা নহে, তিনি আমাদের সুগোচর, সেও একটা কারণ। রামকে যেটুকু দেখিলে একটি সমগ্ররসে তিনি আমাদের কাছে জাগিয়া উঠেন, সমস্ত বিক্ষিপ্ততা বাদ দিয়া রামায়ণ কেবল সেইটুকুই আমাদের কাছে আনিয়াছে; এইজন্য এত স্পষ্ট তাঁহাকে দেখিতে পাইতেছি, এবং স্পষ্ট দেখিতে পাওয়াই মানুষের একটি বিশেষ আনন্দ। স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া মানেই একটা কোনো সমগ্রভাবে দেখিতে পাওয়া, যেন অন্তরাত্মাকে দেখিতে পাওয়া। সাহিত্য তেমনি করিয়া একটা সামঞ্জস্যের সুষমার মধ্যে সমস্ত চিত্র দেখায় বলিয়া আমরা আনন্দ পাই। এই সুষমা সৌন্দর্য।

আর-একটা কথা মনে রাখিতে হইবে, সাহিত্যের একটা বৃহৎ অংশ আছে যাহা তাহার উপকরণবিভাগ। পূর্তবিভাগে কেবল যে ইমারত তৈরি হয় তাহা নহে, তাহার দ্বারা ইঁটের পাঁজাও পোড়ানো হয়। ইঁটগুলি ইমারত নয় বলিয়া সাধারণ লোক অবজ্ঞা করিতে পারে, কিন্তু পূর্তবিভাগ তাহার মূল্য জানে। সাহিত্যের যাহা উপকরণ সাহিত্যরাজ্যে তাহার মূল্য বড়ো কম নয়। এইজন্যই অনেক সময় কেবল ভাষার সৌন্দর্য, কেবল রচনার নৈপুণ্যমাত্রও সাহিত্যে সমাদর পাইয়াছে।

হৃদয়ের ভাব প্রকাশ করিবার জন্য মানুষ যে কত ব্যাকুল তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। হৃদয়ের ধর্মই, সে নিজের ভাবটিকে অন্যের ভাব করিয়া তুলিতে পারিলে তবে বাঁচিয়া যায়। অথচ কাজটি অত্যন্ত কঠিন বলিয়া তাহার ব্যাকুলতাও অত্যন্ত বেশি। সেইজন্য যখন আমরা দেখি একটা কথা কেহ অত্যন্ত চমৎকার করিয়া প্রকাশ করিয়াছে তখন আমাদের এত আনন্দ হয়। প্রকাশের বাধা দূর হওয়াটাই আমাদের কাছে একটা দূর্‌মূল্য ব্যাপার বলিয়া বোধ হয়। ইহাতে আমাদের শক্তি বাড়িয়া যায়। যে কথাটা প্রকাশ হইতেছে তাহা বিশেষ মূল্যবান একটা-কিছু না হইলেও, সেই প্রকাশ-ব্যাপারের মধ্যেই যদি কোনো অসামান্যতা দেখা যায় তবে মানুষ তাহাকে সমাদর করিয়া রাখে। সেইজন্য যাহা তাহা অবলম্বন করিয়া কেবলমাত্র প্রকাশ করিবার লীলাবশতই প্রকাশ, সাহিত্যে অনাদৃত হয় নাই। তাহাতে মানুষ যে কেবল আপনার ক্ষমতাকে ব্যক্ত করিয়া আনন্দদান করে তাহা নহে; কিন্তু যে-কোনো উপলক্ষ ধরিয়া শুদ্ধমাত্র আপনার প্রকাশধর্মটাকে খেলানোতেই তাহার যে আনন্দ সেই নিতান্ত বাহুল্য আনন্দকে সে আমাদের মধ্যেও সঞ্চার করিয়া দেয়। যখন দেখি কোনো মানুষ একটা কঠিন কাজ অবলীলাক্রমে করিতেছে তখন তাহাতে আমাদের আনন্দ হয়; কিন্তু যখন দেখি, কোনো কাজ নয়, কিন্তু যে-কোনো তুচ্ছ উপলক্ষ লইয়া কোনো মানুষ আপনার সমস্ত শরীরকে নিপুণভাবে চালনা করিতেছে তখন সেই তুচ্ছ উপলক্ষের গতিভঙ্গিতেই সেই লোকটার যে প্রাণের বেগ, যে উদ্যমের উৎসাহ প্রকাশ পায় তাহা আমাদের ভিতরকার প্রাণকে চঞ্চল করিয়া সুখ দেয়। সাহিত্যের মধ্যেও হৃদয়ের প্রকাশধর্মের লক্ষ্যহীন নৃত্যচাঞ্চল্য যথেষ্ট স্থান পাইয়াছে। স্বাস্থ্য শ্রান্তিহীন কর্মনৈপুণ্যেও আপনাকে প্রকাশ করে, আবার স্বাস্থ্য যে কেবলমাত্র স্বাস্থ্যই ইহাই সে বিনা কারণেও প্রকাশ করিয়া থাকে। সাহিত্যে তেমনি মানুষ কেবল যে আপনার ভাবের প্রাচুর্যকেই প্রকাশ করিয়া থাকে তাহা নহে, সে আপনার প্রকাশ-শক্তির উৎসাহমাত্রকেই ব্যক্ত করিয়া আনন্দ করিতে থাকে। কারণ, প্রকাশই আনন্দ। এইজন্যই উপনিষদ বলিয়াছেন: আনন্দরূপমমৃতং যদ্‌বিভাতি। যাহা-কিছু প্রকাশ পাইতেছে তাহাই তাঁহার আনন্দরূপ, অমৃতরূপ। সাহিত্যেও মানুষ কত বিচিত্রভাবে নিয়ত আপনার আনন্দরূপকে অমৃতরূপকেই ব্যক্ত করিতেছে তাহাই আমাদের দেখিবার বিষয়।