তপতী

গৌরী। বেদে অগ্নি সূর্য ইন্দ্র বরুণ অনেক দেবতারই স্তব আছে, কিন্তু তোমাদের এই দেবতাটির তো নামও শোনা যায় না।

কালিন্দী। সত্যযুগের ঋষিমুনিরা এঁকে যত সাবধানে এড়িয়ে চলতেন ততই অসাবধানে পড়তেন বিপদে। মুখে তাঁর নাম করতেন না তাই মার খেয়ে মরতেন অন্তরে। পুরাণগুলো পড় নি বুঝি?

গৌরী। মূর্খ আছি সেই ভালো, বিদূষী। সত্যযুগের কলঙ্ককাহিনী কলিযুগে টেনে আনবার মতো এত বিদ্যেয় দরকার কী ভাই। কলিযুগের পাপের ভার যথেষ্ট ভারী আছে।

কালিন্দী। বড়ো লজ্জা দিলে— মূর্খ ব’লে অহংকার করতে পারলুম না — ওখানে কাশ্মীরেরই জিত রইল।

মঞ্জরী। ভাই, তোর কালিন্দীকলকল্লোল একটুখানি থামা। ত্রিবেদীঠাকুর বলেন, কালিন্দীর রসনা তার প্রতিবেশী দশনপংক্তির কাছ থেকে দংশন করবার বিদ্যেটা শিখে নিয়েছে। কেবল সেই বিদ্যেটা ফলাবার জন্যেই যে দেবতাকে মানিস নে তাকে নিয়ে তর্ক তুলেছিস। নতুন দেবতাকে ভক্তি করবার আগে তোর ইষ্টদেবতার সাধনা সারা হোক।

কালিন্দী। তার পরে আসছেন অনিষ্টদেবতাটি। একটু চুপ কর্, ভাই, স্তবটা আর-একবার আউড়ে নিই। দেবতা ত্রুটি মার্জনা করেন, কিন্তু আমাদের সভাকবি তাঁর রচনার আবৃত্তিতে একটু ভুল পেলে কাঁদিয়ে ছাড়েন।

মঞ্জরী। ঐ আসছেন ত্রিবেদীঠাকুর, ওঁর কাছে আজ সন্দেহ মিটিয়ে নিই।

আবৃত্তি করতে করতে ত্রিবেদীর প্রবেশ

ত্রিবেদী।        কর্পূর ইব দগ্ধোহপি শক্তিমান্যো জনে জনে —

                নমোহস্ত্ববার্যবীর্যায় তস্মৈ মকরকেতবে।

মঞ্জরী। আপন মনে কী বকছ, ঠাকুর।

ত্রিবেদী। গোলমাল কোরো না, মুখস্থ করছি।

মঞ্জরী। কী মুখস্থ করছ।

ত্রিবেদী। মকরকেতুর স্তব। রাজার আদেশ।

কালিন্দী। তোমারও এই দশা?

ত্রিবেদী। দেখছ না, মধুকরের গুঞ্জন আর শোনা যাচ্ছে না। সংস্কৃত শৌরসেনী মাগধী অর্ধমাগধী মহারাষ্ট্রী পারসিক যাবনিক নানা ভাষায় আজ অভ্যাস চলছে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে মকরকেতুর সকল দেশের সকল ভাষাতেই পাণ্ডিত্য।

কালিন্দী। কিন্তু অনুচ্চারিত ভাষাই তিনি সব চেয়ে ভালো বোঝেন। দাদাঠাকুর, একটা কথার উত্তর দাও। মকরকেতুর পূজার বিধান পেয়েছ কোন্‌ বেদে।

ত্রিবেদী। চুপ চুপ। কী কণ্ঠস্বরই পেয়েছ তোমরা পুরাঙ্গনারা।

কালিন্দী। অরসিক, বয়স হয়েছে বলে কি কণ্ঠস্বরের বিচারবুদ্ধিটাও খোয়াতে হবে। তোমাদের কবি যে কোকিলের সঙ্গে এই কণ্ঠের তুলনা করেন।

ত্রিবেদী। অন্যায় করেন না। কোনো কথা গোপনে বলবার অভ্যাস ঐ পাখিটার নেই।

কালিন্দী। দাদাঠাকুর, তোমার সঙ্গে গোপন কথা বলবার মতো মনের ভাব আমার নয়। শাস্ত্রের বিচার চাই। এরা বলছিল, পুরাণে অতনুর নেই তনু, আবার বেদে নেই তার নামগন্ধ — বাকি রইল কী। তাহলে পূজাটা হবে কাকে নিয়ে।

ত্রিবেদী। আরে চুপ চুপ — স্বরটাকে আর-এক সপ্তক নামিয়ে আনো।