স্বর্গীয় প্রহসন
অপেক্ষা অনেকগুণে প্রবল হইয়া উঠিয়াছেন। তাঁহাদিগকে স্বপক্ষে পাইলে আমরা নূতন বল লাভ করিতে পারিব। অতএব, গুরুদেব, প্রসন্নচিত্তে তাঁহাদের কন্ঠে দেবমাল্য অর্পণ করিয়া তাঁহাদিগকে স্বর্গলোকে বরণ করিয়া লউন।

বৃহস্পতি। অহো দুর্বৃত্তা নিয়তি! মর্তলোকের প্রসাদলাভলালসায় কত পুরাতন দেবকুলপ্রদীপ ক্রমশ আপন দেবমর্যাদা বিসর্জন দিয়াছেন। দেবসেনাপতি কার্তিকেয় বীরবেশ পরিত্যাগ করিয়া সূক্ষ্মবসন লম্বকচ্ছে কামিনীমনোমোহন নির্লজ্জ নাগরমূর্তি ধারণ করিয়াছেন! গম্ভীরপ্রকৃতি গণপতি কদলীতরুর সহিত গোপন-পরিণয়পাশে বদ্ধ হইয়াছেন এবং মহাযোগী মহেশ্বর গঞ্জিকা-ধুস্তুর-সিদ্ধি-পানে উন্মত্ত হইয়া মহাদেবীর সহিত অশ্রাব্য ভাষায় কলহ করিয়া নীচজাতীয় স্ত্রীপল্লীর মধ্যে আপন বিহারক্ষেত্র বিস্তার করিয়াছেন। সে-সমস্তই যখন একে একে সহ্য করিতে পারিয়াছি তখন বোধ করি দেবাসনে উপদেবতাগণের অধিরোহণদৃশ্যও এই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের ধৈর্যকঠিন বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করিতে পারিবে না।

চন্দ্রের প্রবেশ

ইন্দ্র। ভগবন্‌ উড়ুপতে, স্বর্গলোকে তো কৃষ্ণপক্ষের প্রভাব নাই, তবে অদ্য কেন তোমার সৌম্যসুন্দর প্রফুল্ল মুখচ্ছবি অন্ধকার দেখিতেছি?

চন্দ্র। দেব সহস্রলোচন, স্বর্গে কৃষ্ণপক্ষ থাকিলে অমাবস্যার ছায়ায় আমি আনন্দে আশ্রয় গ্রহণ করিতে পারিতাম। দেবরাজ, দেবী শীতলার প্রসন্ন দৃষ্টি হইতে আমাকে নিস্কৃতি দান করো। তিনি স্বর্গে পদার্পণ করিয়া অবধি আমার প্রতি যে বিশেষ পক্ষপাত প্রকাশ করিতেছেন, আমি একাকী তাহার যোগ্য নহি। তাঁহার সেই প্রচুর অনুগ্রহ দেবসাধারণের মধ্যে সমভাগে বিভক্ত হইলে কাহারও প্রতি অন্যায় হয় না।

ইন্দ্র। সুধাংশুমালিন্‌, সুহৃদগণের সহিত ভাগ করিয়া ভোগ করিলে অধিকাংশ আনন্দই বৃদ্ধি পাইয়া থাকে সন্দেহ নাই, কিন্তু রমণীর অনুগ্রহ সে জাতীয় নহে।

চন্দ্র। ভগবন্‌, তবে সে আনন্দ তুমিই সম্পূর্ণ গ্রহণ করো। তুমি সুরশ্রেষ্ঠ, এ সুধাবেগ তুমি ব্যতীত আর-কেহ একাকী সংবরণ করিতে পারিবে না।

ইন্দ্র। প্রিয়সখে। অন্যের নিকট যাহা পাওয়া যায় তাহা বন্ধুকে দান করা কঠিন নহে, কিন্তু প্রেম সেরূপ সামগ্রী নহে। তুমি যাহা পাইয়াছ তাহা তুমি অনাদরে ফেলিয়া দিতে পার, কিন্তু প্রিয়তম বন্ধুর অত্যাবশ্যক পূরণ করিবার জন্যও তাহা দান করিতে পার না।

চন্দ্র। যদি ফেলিয়া দিতে পারিতাম, তবে বিপন্নভাবে তোমার দ্বারস্থ হইতাম না। সুরপতে, অনেক সৌভাগ্য আছে যাহা দূরে নিক্ষেপ করিলেও নিকটে সংলগ্ন হইয়া থাকে।

ইন্দ্র। শশলাঞ্ছন, তুমি কি অপযশের ভয় করিতেছ?

চন্দ্র। সখে, সত্য বলিতেছি, কলঙ্কের ভয় আমার নাই।

ইন্দ্র। কলানাথ, তবে কি তুমি তোমার অন্তঃপুরলক্ষ্মী প্রিয়তমার অসূয়া আশঙ্কা করিতেছ?

চন্দ্র। বন্ধো, তোমার অবিদিত নাই, সপ্তবিংশতি নক্ষত্রনারী লইয়া আমার অন্তঃপুর। তাহারা প্রত্যেকেই সমস্ত রাত্রি অনিমেষ নেত্রে জাগ্রত থাকিয়া আমার গতিবিধি নিরীক্ষণ করিয়া থাকে, তথাপি এ পর্যন্ত নক্ষত্রলোকে কোনোরূপ অশান্তির কারণ ঘটে নাই। সপ্তবিংশতির উপর আর-একটি যোগ করিতে আমি ভীত নহি।

ইন্দ্র। সখে, ধন্য তোমার সাহস! তবে তোমার ভয় কিসের?