বিনি পয়সার ভোজ
আপিসের বেশে অক্ষয়বাবু

(হাসিতে হাসিতে) আজ আচ্ছা জব্দ করেছি। বাবু রোজ আমাদের স্কন্ধে বিনামূল্যে বিনামাশুলে ইয়ার্কি দিয়ে বেড়ান, আর লম্বাচওড়া কথা কন। মশায়, আজ বছর-খানেক ধরে রোজ বলে ‘ আজ খাওয়াব'‘ কাল খাওয়াব', খাওয়াবার নাম নেই। যতখানি আশা দিয়েছে তার সিকি পরিমাণ যদি আহার দিত তা হলে এতদিনে তিনটে রাজসূয় যজ্ঞ হতে পারত। যা হোক, আজ তো বহু কষ্টে একটা নিমন্ত্রণ আদায় করা গেছে। কিন্তু, দুটি ঘণ্টা বসে আছি এখনো তার দেখা নেই। ফাঁকি দিলে না তো?

(নেপথ্যে চাহিয়া) ওরে, কী তোর নাম, ভূতো না মোধো, না হরে?

চন্দ্রকান্ত? আচ্ছা, বাপু, তাই সই। তা, ভালো চন্দ্রকান্ত, তোমার বাবু কখন আসবে বলো দেখি।

কি বললি? বাবু হোটেল থেকে খাবার কিনে আনতে গেছেন? বলিস কী রে! আজ তবে তো রীতিমত খানা! খিদেটিও দিব্যি জমে এসেছে। মটন-চপের হাড়গুলি একেবারে পালিশ করে হাতির দাঁতের চুষিকাঠির মতো চক্‌চকে করে রেখে দেব। একটা মুর্গির কারি অবিশ্যি থাকবে— কিন্তু, কতক্ষণই বা থাকবে! আর দু-রকমের দুটো পুডিং যদি দেয় তা হলে চেঁচেপুঁচে চীনের বাসনগুলোকে একেবারে কাঁচের আয়না বানিয়ে দেব। যদি মনে ক'রে ডজন-দুত্তিন অয়্‌স্টার প্যাটি আনে তা হলে ভোজনটি বেশ পরিপাটি রকমের হয়। আজ সকাল থেকে ডান চোখ নাচছে, বোধ হয় অয়্‌স্টার প্যাটি আসবে।

ওহে ও চন্দ্রকান্ত, তোমার বাবু কখন গেছেন বলো দেখি।

অনেকক্ষণ গেছেন? তবে আর বিস্তর বিলম্ব নেই। ততক্ষণ এক ছিলিম তামাক দাও-না। অনেকক্ষণ ধরে বলছি, কিন্তু তোমার কোনো গা দেখছি নে।

তামাক বাইরে নেই? বাবু বন্ধ করে রেখে গেছেন? এমন তো কখনো শুনি নি। এ তো কোম্পানির কাগজ নয়। কী করা যায়! আমি একটু-আধটু আফিম খাই, তামাক না হলে আর তো বাঁচি নে। ওহে মোধো, না, না, চন্দ্রকান্ত, কোনোমতে মালীদের কাছ থেকে হোক, যেখান থেকে হোক, এক ছিলিম জোগাড় করে দিতে পার-না?

বাজার থেকে কিনে আনতে হবে? পয়সা চাই? আচ্ছা বাপু, তাই সই। এই নাও, এক পয়সার তামাক চট করে কিনে নিয়ে এসো।

এক পয়সার তামাক হবে না? কেন হবে না! বাপু, আমাকে কি মুচিখোলার নবাব বলে হঠাৎ তোমার ভ্রম হয়েছে? ষোলো টাকা ভরি অম্বুরি তামাক না হলেও আমার কষ্টেসৃষ্টে চলে যায়— এক পয়সাতেই ঢের হবে।

হুঁকো-কলকেও কিনে আনতে হবে? সেও তোমার বাবু লোহার সিন্দুকে পুরে রেখে গেছেন নাকি? বাঙাল ব্যাঙ্কে সেফ ডিপজিট করে আসেন নি কেন! ওরে বাস রে! এ তো ভালো জায়গায় এসে পড়া গেছে দেখছি। তা নাও, এই ছটি পয়সা ট্র্যামের জন্যে রেখেছিলুম। উদয় ফিরে এলে তার কাছ থেকে সুদ-সুদ্ধ আদায় করে নিতে হবে।— এই বুঝি বাবুর বাগানবাড়ি, তা হলে এঁর ভদ্রাসন-বাড়ি কিরকম হবে না জানি! কড়িগুলো মাথায় ভেঙে না পড়লে বাঁচি। এই তো একখানি ভাঙা চৌকি আসবাবের মধ্যে। এ আমার ভর সইবে না। সেই অবধি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে পা ব্যথা হয়ে গেল— আর তো পারি নে— এই মাটিতেই বসা যাক।