গোড়ায় গলদ
ধরে টেনে নিয়ে আসে। যে শরতের আকাশের মতো এ দিকে বেশ নির্মল কিন্তু কখন রোদ উঠবে, কখন মেঘ করবে, কখন বৃষ্টি হবে, কখন বিদ্যুৎ দেখা দেবে, তা স্বয়ং বিজ্ঞানশাস্ত্রের পিতৃপিতামহও ঠিক করে বলতে পারে না।

চন্দ্রকান্ত। বুঝেছি—যে কোনোকালেই পুরোনো হবে না। মনের কথা টেনে বলেছ ভাই। কিন্তু পাওয়া শক্ত। আমরা ভুক্তভোগী, জানি কি না, বিয়ে করলেই মেয়েগুলো দুদিনেই বহুকেলে পড়া-পুঁথির মতো হয়ে আসে; মলাটটা আধখানা ছিঁড়ে ঢলঢল করছে, পাতাগুলো দাগি হয়ে খুলে খুলে আসছে—কোথায় সে আঁটসাঁট বাঁধুনি, কোথায় সে সোনার জলের ছাপ—তা ছাড়া যেখানে খুলে দেখ সেই এক কথা—“কমলিনী অতি সুবোধ মেয়ে, সে ঘরকন্নায় কদাচ আলস্য করে না; সে প্রত্যুষে উঠিয়াই গৃহমার্জন এবং গোময়লেপন করে ; যথাসময়ে স্বামীর অন্নব্যঞ্জন প্রস্তুত করিয়া রাখে, যাহাতে তাঁহার আপিসে যাইতে বিলম্ব না হয়; আপিস হইতে ফিরিয়া আসিলে তাঁহার গাড়ু-গামছা ঠিক করিয়া রাখে এবং রাত্রিকালে তাঁহার মশারি ঝাড়িয়া দেয়!” আগাগোড়া একটা নীতি-উপদেশের মতো। স্ত্রী হবে কেমন—রোজ এক-এক পাতা ওলটাবে আর এক-একটা নতুন চ্যাপ্টার বেরোবে।

নিমাই। অর্থাৎ কোনোদিন বা গৃহমার্জন করবে, কোনোদিন বা স্বামীর পৃষ্ঠমার্জন করবে! একদিন বা মেঝেতে গোময় লেপন করলে, একদিন বা স্বামীর পবিত্র মাথার উপর ঘোল সেচন করলে—পূর্বাহ্নে কিছুই ঠিক করবার জো নেই।

চন্দ্রকান্ত। সে যেন হল—আর চেহারাটা কী রকম হবে।

বিনোদবিহারী। চেহারাটি বেশ ছিপছিপে, মাটির সঙ্গে অতি অল্পই সর্ম্পক, যেন ‘সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতেব।’ অর্থাৎ যাকে দেখে মনে হবে অতি ক্ষীণবল—অস্তিত্বটুকু কেবল নামমাত্র—অথচ ঐটুকুর মধ্যে যে এত লীলা, এত বল, এত কৌতুক তাই দেখে পলকে পলকে আশ্চর্য বোধ হবে। যেন বিদ্যুতের মতো, একটিমাত্র আলোর রেখা—কিন্তু তার ভিতরে কত চাঞ্চল্য, কত হাসি, কত বজ্রতেজ।

চন্দ্রকান্ত। আর বেশি বলতে হবে না—আমি বুঝে নিয়েছি। তুমি চাও পদ্যর মতো চোদ্দটি অক্ষরে বাঁধাসাঁধা, ছিপছিপে; অমনি, চলতে ফিরতে ছন্দটি রেখে চলে, কিন্তু এ দিকে মল্লিনাথ, ভরত শিরোমণি, জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন প্রভৃতি বড়ো বড়ো পণ্ডিত তাঁর টিকে ভাষ্য করে থই পায় না। বুঝেছ বিনদা, আমিও তাই চাই, কিন্তু চাইলেই তো পাওয়া যায় না—

বিনোদবিহারী। কেন, তোমার কপালে তো মন্দ জোটে নি।

চন্দ্রকান্ত। মন্দ বলতে সাহস করিনে—কিন্তু ভাই, পদ্য নয় সে গদ্য—বিধাতা অক্ষর মিলিয়ে তাকে তৈরি করেন নি, কলমে যা এসেছে তাই বসিয়ে গেছেন—এই প্রতিদিন যে-ভাষায় কথাবার্তা চলে তাই আর-কি। ওর মধ্যে বেশ একটি ছাঁদ পাওয়া যাচ্ছে না।

নিমাই। আর ছাঁদে কাজ নেই ভাই। আবার তোমার কী রকম ছাঁদ সেটাও তো দেখতে হবে। বিনোদ লেখক-মানুষ, ওর মুখে সকলরকম খ্যাপামিই শোভা পায়, ও যদি হঠাৎ মাঝের থেকে বিদ্যুৎ কিংবা অনুষ্টুভ ছন্দকে বিয়ে করে বসে ও তাদের সামলাতে পারে, বরঞ্চ ওকে নিয়েই তারা কিছু ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু চন্দরদা, তোমার সঙ্গে একটি আস্ত পদ্য জুড়ে দিলে কি আর রক্ষে ছিল ; এক লাইন পদ্য আর এক লাইন গদ্যে কখনো মিল হয়?

চন্দ্রকান্ত। সে কথা অস্বীকার করবার জো নেই। কিন্তু আমাকে বাইরে থেকে যা দেখিস নিমাই, ভিতরে যে কিছু পদ্য নেই তা বলতে পারি নে। আমি, যাকে বলে, চম্পূকাব্য! গঙ্গাজল ছুঁয়ে বললেও কেউ বিশ্বাস করে না, কিন্তু মাইরি বলছি আমারও মন এক-একদিন উড়ু-উড়ু করে—এমন-কি, চাঁদের আলোয় শুয়ে পড়ে পড়ে এমনও ভেবেছি—আহা, এই সময় প্রেয়সী যদি চুলটি বেঁধে, গাটি ধুয়ে, একখানি বাসন্তী রঙের কাপড় প’রে, একগাছি বেলফুলের মালা হাতে করে নিয়ে এসে গলায় পরিয়ে দেয় আর মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে বলতে থাকে—