মালঞ্চ

আদিত্য। হাঁ, মনে করব।

বলল বটে, কিন্তু এমন সুরে বলতে পারলে না যাতে তার বিশ্বাসের প্রমাণ হয়।

নীরজা। (অস্থির হয়ে) তোমাদের বই যারা লেখে ভারী তো পণ্ডিত তারা। কিছু জানে না। আমি নিশ্চয় জানি, আমার কথা বিশ্বাস করো। আমি থাকব, আমি এইখানেই থাকব, আমি তোমারই কাছে থাকব, একেবারে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এই তোমাকে বলে যাচ্ছি, কথা দিয়ে যাচ্ছি, তোমার বাগানের গাছপালা সমস্তই আমি দেখব। যেমন আগে দেখতুম তার চেয়ে অনেক ভালো করে দেখব। কাউকে দরকার হবে না। কাউকে না।

শুয়ে ছিল, উঠে বালিশে ঠেসান দিয়ে বসে

আমাকে দয়া কোরো, দয়া কোরো। তোমাকে এত ভালোবাসি সেই কথা মনে করে আমাকে দয়া কোরো। এতদিন তুমি আমাকে যেমন আদরে স্থান দিয়েছ তোমার ঘরে, সেদিনও তেমনি করেই স্থান দিয়ো। ঋতুতে ঋতুতে তোমার যে-সব ফুল ফুটবে তেমনি করেই মনে মনে তুলে দিয়ো আমার হাতে। যদি নিষ্ঠুর হও তুমি, তা হলে তো এখানে আমি থাকতে পারব না। আমার বাগান যদি কেড়ে নাও তা হলে হাওয়ায় হাওয়ায় কোন্‌ শূন্যে আমি ভেসে বেড়াব?

নীরজার দুই চক্ষু দিয়ে জল ঝরে পড়তে লাগল। আদিত্য মোড়া ছেড়ে বিছানার উপর উঠে বসল।
নীরজার মুখ বুকে টেনে নিয়ে আস্তেআস্তে হাত বুলোতে লাগল তার মাথায়।

আদিত্য। নীরু, শরীর নষ্ট কোরো না।

নীরজা। যাক গে আমার শরীর। আমি আর কিচ্ছু চাই নে, আমি কেবল তোমাকে চাই এই সমস্ত কিছু নিয়ে। শোনো একটা কথা বলি, রাগ কোরো না আমার উপর, রাগ কোরো না, (বলতে বলতে স্বর রুদ্ধ হয়ে এল। একটু শান্ত হয়ে—) সরলার উপর অন্যায় করেছি। তোমার পায়ে ধরে বলছি আর অন্যায় করব না। যা হয়েছে তার জন্যে আমাকে মাপ করো। কিন্তু আমাকে ভালোবাস তুমি, যা চাও আমি সব করব।

আদিত্য। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মন ছিল অসুস্থ নীরু, তাই নিজেকে মিথ্যা পীড়ন করেছ।

নীরজা। শোনো বলি। কাল রাত্রি থেকে বার বার পণ করেছি, এবার দেখা হলে নির্মল মনে ওকে বুকে টেনে নেব আপন বোনের মতো। তুমি আমাকে এই শেষ প্রতিজ্ঞা রক্ষায় সাহায্য করো। বলো, আমি তোমার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হব না। তা হলে সবাইকে আমার ভালোবাসা দিয়ে যেতে পারব।

এ কথার কোনো উত্তর না করে মুদে এল নীরজার চোখ। খানিক বাদে নীরজা জিজ্ঞাসা করলে—

সরলা কবে খালাস পাবে সেই দিনই গুনছি। ভয় হয় পাছে তার আগে মরে যাই। পাছে বলে যেতে না পারি যে আমার মন একেবারে সাদা হয়ে গেছ। এইবার আলো জ্বালাও। আমাকে পড়ে শোনাও অক্ষয় বড়ালের ‘এষা’।


বালিশের নীচ থেকে বই বের করে দিলে। আদিত্য পড়ে শোনাতে লাগল।শুনতে শুনতে যেই
একটু ঘুম এসেছে আয়া ঘরে এসে বললে—